গোলমাল থামাইয়া, বাজনা থামাইয়া সারা সভাটি চুপচাপ।
তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রৌপদীকে সভার মাঝখানে আনিয়া গম্ভীরস্বরে বলিতে লাগিলেন, “আপনারা সকলে শুনুন। এই ধনুর্বাণ আর ঐ লক্ষ্য আপনারা দেখিতেছেন। ঐ যে একটা কলের মতন, তাহাতে ছিদ্র আছে তাহাও দেখুন। ঐ ছিদ্রের ভিতর দিয়া পাঁচটি তীর মারিয়া লক্ষ্য বিঁধিয়া মাটিতে ফেলিতে হইবে। এ কাজ যিনি করিতে পারিবেন, তিনিই দ্রৌপদীকে পাইবেন।”
সভার সকলেই ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। এত রাজারাজড়ার মধ্যে না জানি কে আজ দ্রৌপদীকে লইয়া যায়। সেই সভায় কৃষ্ণ আর বলরামও উপস্থিত ছিলেন। কৃষ্ণ চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন যে, পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই ছদ্মবেশে ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে বসিয়া আছে। ইহাতে যারপরনাই আনন্দিত হইয়া তিনি চুপিচুপি বলরামকে এ কথা জানাইলেন। কিন্তু তাঁহারা দুভাই ভিন্ন আর কেহই পাণ্ডবদিগকে চিনিতে পারিল না। তাহারা তামাশা দেখিতেই ব্যস্ত ছিল।
এদিকে বাজনা বাজিতেছে, আর রাজাদিগের মধ্য হইতে এক-একজন করিয়া লক্ষ্য বিঁধিয়া বিদ্যার পরীক্ষা দিতে যাইতেছেন। হায় হায়! সে সর্বনেশে ধনুক কাহারো হাতে বাগ মানিতে চাহে না: বরং তাহার ধাক্কায় রাজামহাশয়েরাই ঠিকরাইয়া পড়েন। বড়-বড় রাজা পর্যন্ত কেহ চিৎপাৎ হইয়া, কেহ ডিগবাজি খাইয়া, কাহারো পাগড়ি উড়িয়া গিয়া, নাকালের একশেষ। তাঁহাদের মুখে আর কথাটি নাই।
এমন সময় কর্ণ আসিয়া দেখিতে দেখিতে সেই ধনুকে গুণ আর তীর চড়াইয়া লক্ষ্য বিধিতে প্রস্তুত হইলেন। তাহা দেখিয়া পাণ্ডবেরা মনে করিলেন, এই বুঝি লক্ষ্য বিঁধিয়া দ্রৌপদীকে লইয়া যায়।
কিন্তু কর্ণকে দেখিয়া দ্রৌপদী বলিলেন, “সারথির ছেলের গলায় মালা দিতে পারিব না, কাজেই কর্ণকে লক্ষ্য না বিঁধিয়াই ফিরিয়া যাইতে হইল।”
সেদিন রাজামহাশয়দের যে দুর্দশা! শিশুপালের তো হাঁটুই ভাঙ্গিয়া গেল! জরাসন্ধ গুতা খাইয়া চিৎপাৎ! তারপর তাড়াতাড়ি উঠিয়া ধূলা ঝাড়িতে ঝাড়িতে সেই যে তিনি সেখান হইতে চলিলেন, আর একেবারে নিজের ঘরে না পৌছিয়া থামিলেন না। শল্যেরও প্রায় সেই দশা!
অর্জুন এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন, রাজামহাশয়দের দুরবস্থা দেখিয়া এইবার তিনি উঠিয়া দাঁড়াইয়াছেন। অর্জুনকে লক্ষ্য বিধিতে যাইতে দেখিয়া ব্রাহ্মাদিগের আনন্দের আর সীমা-পরিসীমা রহিল না। তাঁহারা তাঁহাদের বসিবার হরিণের ছাল ঘুরাইয়া চিৎকার আরম্ভ করিলেন। কেহ কেহ যে আবার বিরক্তও না হইলেন এমন নহে। তাঁহারা বলিলেন, “আরে কর কি ঠাকুর? থামো, থামো! এ ব্যক্তি দেখিতেছি আমাদের সকলকে অপদস্থ করাইবে। বড় বড় রাজারা যাহা পারিল না, সেটা ইহার না করিলেই নয়। বেচারার মাথা ঘুরিয়া গিয়াছে আর কি।”
তাহা শুনিয়া আর অনেকে বলিলেন “তোমরা ব্যস্ত হইয়াছ কেন? ইহাকে যাইতে দাও ব্রাহ্মণে না করিতে পারে এমন কাজ আছে? ইনি কোনো মহাপুরুষ হইবেন। দেখিতেছ না, ইহার কেমন চেহারা? ও গায় কি তেজ! কাঁধ কি চওড়া! হাত কি লম্বা! এমন সুন্দর আর