একটা মানুষ এখানে খুঁজিয়া বাহির কর দেখি। ইনি নিশ্চয় পারিবেন। তোমরা চুপ করিয়া দেখ। ঐ তিনি ধনুকে গুণ চড়াইতেছে"৷
অর্জুন ধনুকের কাছে একটু থামিয়া ব্রাহ্মাদিগের কথাবার্তা শুনিতেছিলেন, তারপর তিনি দেবতাকে স্মরণ করিয়া ধনুকখানি হাতে লইলেন। সে ধনুকে গুণ চড়ানো কি আর অর্জুনের কাছে একটা কঠিন কাজ? তিনি চক্ষের পলকে গুণ চড়াইয়া, পাঁচটি তীর হাতে লইলেন। তারপর দেখিতে দেখিতে লক্ষ্য বিঁধিয়া মাটিতে পড়িল। সকলে দেখিয়া অবাক!
তখন আকাশ হইতে দেবতারা জয় জয় শব্দে অর্জুনের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিলেন আর ব্রাহ্মণদিগের কথা কি বলিব! হরিণের ছাল, কুশাসন, চাদর, কোঁচা কিছুই তাঁহারা ঘুরাইতে বাকি রাখিলেন না। তারপর বাজনদারেরা যে তাহাদের সকলগুলি ঢাক, ঢোল, সানাই, কাড়া আর কাঁসি একসঙ্গে মিলাইয়া একটা কাণ্ড করিয়াছিল, তাহা যদি শুনিতে!
সেই আনন্দ কোলাহলের ভিতরে দ্রৌপদী হাসিতে হাসিতে অর্জুনকে মালা দিয়া তাঁহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন৷
এদিকে কিন্তু রাজামহাশয়দের মুখ ভার আর চোখ লাল। তাঁহারা নিজে যে সকলেই সেদিন কি অদ্ভুত বিদ্যা দেখাইয়াছে, সে কথা আর তাঁহাদের মনে নাই। তাঁহারা থাকিতে ব্রাহ্মণ কেন মেয়ে লইয়া গেল, তাই তাঁদের রাগ! “এমন কথা? আমাদিগকে ডাকিয়া আনিয়া অপমান করিল? অ্যাঁ বলেন কি মহাশয়?”
“তাইতো! এমন কথা? অপমান করিল? অ্যাঁ!—মার্! মার্! দ্রুপদকে মার্ আর ঐ হতভাগা মেয়েটাকে পোড়াইয়া ফেল্?”
এই বলিয়া সকল রাজা একজোটে দ্রুপদকে আক্রমণ করিতে আসিল। দ্রুপদ আর উপায় না দেখিয়া ব্রাক্ষণদিগের নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন। অর্জুন ইহার পূর্বেই ধনুক বাণ লইয়া প্রস্তুত। ততক্ষণে ভীমও একটা বড়গোছের গাছ উপড়াইয়া ডাল-পাতা ঝাড়িয়া বেশ মজবুত একটি লাঠি প্রস্তুত করিয়া লইয়াছেন৷
এদিকে এ সকল কাণ্ড দেখিয়া কৃষ্ণ বলরামকে বলিতেছেন, “দাদা, এ ধনুক অর্জুন ভিন্ন আর কেহই এমন করিয়া বাগাইতে পারে না আর এমন করিয়া গাছ ভাঙ্গিয়া লাঠি তয়ের করাও ভীম ছাড়া আর কাহারো কর্ম নহে। আর ঐ তিনজন নিশ্চয় যুধিষ্ঠির নকুল আর সহদেব। শুনিয়াছিলাম, পিসীমা (অর্থাৎ কুন্তী, ইনি কৃষ্ণ বলরামের পিসীমা) আর পাণ্ডবেরা জতুগৃহ হইতে রক্ষা পাইয়াছেন। এখন দেখিতেছি তাহা সত্য৷”
বলরাম বলিলেন, “পিসীমা বাঁচিয়া আছে শুনিয়া বড়ই সুখী হইলাম৷”
রাজারা যুদ্ধ করিতে আসিতেছে দেখিয়া ব্রাহ্মণদিগের বড়ই রাগ হইল। তাঁহারা হরিণের ছাল আর কমণ্ডলু ঘুরাইয়া ভীম অর্জুনকে বলিলেন, “তোমাদের কোনো ভয় নাই। আমরা তোমাদের হইয়া যুদ্ধ করিব৷”
অর্জুন তাহাতে একটু হাসিয়া বলিলেন, “আপনারা দাঁড়াইয়া দেখুন, আমরাই ইহাদিগকে তাড়াইয়া দিতেছি৷”
তারপর যুদ্ধ আরম্ভ হইল, কর্ণ অর্জুনকে আর শল্য ভীমকে মারিবার জন্য দাঁত কড়মড় করিতে করিতে ছুটলেন, আর অন্য সকলে মিলিয়া ব্রাহ্মণদিগকে তাড়া করিলেন। কর্ণও খুব রাগিয়া তীর মারেন, অর্জুনও তেমনি তেজের সহিত তাঁহাকে সাজা দেন।