পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
২৯৯

আসিয়া, কৌরবদিগকে সংহার করিতে লাগিল। কর্ণ তথাপি যথাসাধ্য বাণবৃষ্টি করিতেছিলেন, কিন্তু তাহাতে বিশেষ কিছুই হইল না। এদিকে ঘটোৎকচ শতঘ্নী মারিয়া তাহার ঘোড়া কয়টিকে বধ করিয়াছে।

 এমন সময় কৌরবেরা সকলে মিলিয়া কর্ণকে কহিলেন, “আর কি দেখিতেছ? শীঘ্ন ইন্দ্রের সেই একপুরুষঘাতিনী শক্তি দিয়া এই রাক্ষসকে বধ কর।”

 কর্ণ দেখিলেন যে, রাক্ষসের হাতে প্রাণ যায় যায়;কাজেই তখন তিনি নিরুপায় হইয়া, সেই একপুরুষঘাতিনী শক্তি হাতে লইলেন।

 সে শক্তি দেখিবামাত্র ঘটোৎকচ নিজের দেহকে বিশাল পর্বতের ন্যায় বড় করিয়া, উধশ্বাসে পলাইতে লাগিল। জীব-জন্তুরা চিৎকার করিয়া উঠিল, ঝড় বহিল, বজ্রপাত আরম্ভ হইল; আর সেই মহাশক্তি, কর্ণের হাত হইতে ছুটিয়া গিয়া ঘটোৎকচের বুক ভেদ করত, উধর্বমুখে প্রস্থান করিল।

 ঘটোৎকচ পড়িবার সময়, এক অক্ষৌহিণী কৌরব সৈন্য তাহার সেই বিশাল শরীরের চাপে মারা গেল। তাহার মৃত্যুতে পাণ্ডবদের কিরূপ দুঃখ হইল, বুঝিতেই পার। কিন্তু কৃষ্ণ ইহার মধ্যে সিংহনাদপূর্বক অর্জুনকে আলিঙ্গন করিয়া, সেই রথের উপরেই নাচিতে লাগিলেন। ইহাতে অর্জুন ব্যথিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এমন দুঃখের সময় কিজন্য আপনি এত আনন্দ প্রকাশ করিতেছেন?”

 কৃষ্ণ বলিলেন, “আনন্দ করিতেছি এইজন্য যে, কর্ণ সেই শক্তি ঘটোৎকচের উপর মারাতে, তোমার বিপদ কাটিয়া গেল। ঘটোৎকচকে না মারিলে ঐ শক্তি দিয়া সে তোমাকে বধ করিত। এখন উহা তাহার হাত হইতে চলিয়া গেল, এরপর তুমি অনায়াসেই তাহাকে মারিতে পারিবে।”

 কিন্তু ঘটোৎকচের গুণের কথা মনে করিয়া কেহই স্থির থাকিতে পারিল না। জন্মাবধি সে এক মুহূর্তও নিজের সুখের দিকে না চাহিয়া, পাণ্ডবদিগের কত সেবা করিয়াছে, যুধিষ্ঠির সে সকলের কথা বলিতে বলিতে, রাগে এবং দুঃখে অস্থির হইয়া কর্ণকে বধ করিতে চলিলেন। ভীম তো তখন হইতে কৌরবদিগকে এক ধার হইতে মারিতে আরম্ভ করিয়াছেন, এ পর্যন্ত ক্ষান্ত হন নাই।

 এমন সময় অর্জুন সকলকে বলিলেন, “রাত্রি অনেক হইয়াছে, আর তোমরাও অন্ধকারে যুদ্ধ করিয়া নিতান্তই ক্লান্ত হইয়াছ। সুতরাং এই বেলা একটু বিশ্রাম করিয়া লও, চন্দ্র উঠিলে আবার যুদ্ধ করা যাইবে।” অর্জুনের কথায় সকলে সন্তুষ্ট হইয়া, যিনি যেমনভাবে ছিলেন, সেইভাবেই, কেহ ঘোড়ায়, কেহ রথে, কেহ হাতিতে, কেহ সেই রণস্থলের কাদার উপরেই ঘুমাইয়া পড়িলেন। অস্ত্রশস্ত্র যোদ্ধাদিগের হাতেই রহিল।

 শেষ রাত্রিতে চাঁদউঠিলে, আবার যুদ্ধ আরম্ভ হইল। ভোরবেলায় দ্রুপদ, এবং তিনটি পৌত্র সহ বিরাট, দ্রোণের হাতে মারা গেলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন শোকে অধীর হইয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন, “আজ যদি আমি দ্রোণকে বধ না করি, তবে যেন আমার স্বর্গলাভ না হয়।”

 এই বলিয়া তিনি ভীমের সহিত দ্রোণ-সৈন্য আক্রমণ করিলেন। তখনকার যুদ্ধ কি ঘোরতরই হইল। দুর্যোধন ও দুঃশাসন নকুল ও সহদেবের সহিত, কর্ণ ভীমের সহিত, দ্রোণ অর্জুনের সহিত, এমনই যুদ্ধ করিতে লাগিলেন যে, সকলে তাহা দেখিয়া অবাক হইয়া গেল।