পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৪২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪২৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

উপস্থিত হল।

 রাজবাড়ির অন্দরমহলে রাজামহাশয় ঘুমিয়ে আছেন, রানী তাঁর মাথার কাছে বসে তাঁকে হাওয়া করছেন, এমন সময় কথা নেই বার্তা নেই, গুপি আর বাঘা সেই সর্বনেশে ঢোল নিয়ে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হল। জুতোর এমনি গুণ, দরজা জানালা সব বন্ধ রয়েছে, তাতে তাদের একটুও আটকায় নি। কিন্তু আসবার বেলা আটকাক, আর নাই আটকাক, আসবার পরে খুবই আটকাল। রানী তাদের দেখে বিষম ভয় পেয়ে, এক চিৎকার দিয়ে তখনই অজ্ঞান হয়ে গেলেন, রাজামশাই লাফিয়ে উঠে পাগলের মত ছুটাছুটি করতে লাগলেন, রাজবাড়িময় হুলস্থূল পড়ে গেল। সিপাই সান্ত্রী সব খাঁড়া ঢাল নিয়ে ছুটে এল।

 বেগতিক দেখে গুপি আর বাঘার মাথায় গোল লেগে গেল। তারা যদি তখন শুধু বলে, ‘আমরা এখান থেকে অমুক জায়গায় চলে যাব,’ সেই তাদের জুতোর গুণে সকল ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু সে কথা তাদের মনেই হল না। তারা গেল ছুটে পালাতে, আর দু-পা যেতে যেতেই বেচারারা যে মারটা খেল! জুতো, লাঠি, চাবুক, কিল, চড়, কানমলা তাদের বাকি রইল না। শেষে রাজামশাই হুকুম দিলেন, ‘বেটাদের নিয়ে তিন দিন হাজতে ফেলে রাখো। তারপর বিচার করে, হয় এদের মাথা কাটব, না হয় কুত্তা দিয়ে খাওয়াব।’

 হায় গুপি! হায় বাঘা! বেচারারা এসেছিল রাজাকে গান শুনিয়ে কতই বকশিশ পাবে ভেবে তার মধ্যে এ কি বিপদ? পেয়াদারা তাদের হাত বেঁধে মারতে মারতে একটা অন্ধকার ঘরে নিয়ে ফেলে রাখল। সেখানে পড়ে বেচারারা একদিন আর গায়ের ব্যথায় নড়তে চড়তে পারল না। তাতে তেমন দুঃখ ছিল না, কিন্তু বাঘার ঢোলটি যে গেল, সেই হল সর্বনাশের কথা! বাঘা বুক মাথা চাপড়িয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে, আর বলছে, ‘ও গুপিদা।—ওঃ-ওঃ-হ-হ-হ-হ-অ-অ! আরে ও গুপিদা! মার খেলাম, প্রাণ যাবে, তাতে দুঃখ নেই কিন্তু দাদা, আমার ঢোলকটি যে গেল!’

 গুপির কিন্তু ততক্ষণে মাথা ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। সে বাঘার গায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ভয় কি দাদা? ঢোল গিয়েছে, জুতো আর থলে ত আছে। আমরা নিতান্ত বেকুব, তাই এতগুলো মার খেলাম। যা হোক, যা হবার হয়ে গিয়েছে, এখন এর ভিতর থেকে একটু মজা করে নিতে হবে।’ বাঘা এ কথায় একটু শান্ত হয়ে বলল, ‘কি মজা করবে দাদা?’ গুপি বলল, ‘আগে ত খাবার মজাটা করে নিই, তারপর অন্য মজার কথা ভেবে দেখব এখন।’

 এই বলে সে সেই ভূতের দেওয়া থলির ভিতরে হাত দিয়ে বলল, ‘দাও ত দেখি, এক হাঁড়ি পোলাও।’ অমনি একটা সুগন্ধ যে বেরুল! তেমন পোলাও রাজারাও সচরাচর খেতে পান না। আর সে কি বিশাল হাঁড়ি! গুপি কি সেটা থলির ভিতর থেকে তুলে আনতে পারে? যা হোক, কোনমতে সেটাকে বার করে এনে তারপর থলিকে বলল, ‘ভাজা, ব্যঞ্জন, চাটনি, মিঠাই, দই, রাবড়ি, শরবত।—শিগ্‌গির শিগ্‌গির দাও।’ দেখতে দেখতে খাবার জিনিসে আর সোনারূপোর বাসনে ঘর ভরে গেল। দুজন লোকে আর কত খাবে? সে অপূর্ব খাবার খেয়ে তাদের গায়ের ব্যথা কোথায় চলে গেল তার আর ঠিক নেই।

 তখন বাঘা বলল, ‘দাদা, চলো এই বেলা এখান থেকে পালাই, নইলে শেষে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবে।’ গুপি বলল, ‘পাগল হয়েছ নাকি? আমাদের এমন জুতো থাকতেই কুত্তা দিয়ে খাওয়াবে? দেখাই যাক না, কি হয়।’ এ কথায় বাঘা খুব খুশি হল, সে বুঝতে পারল যে,