মহাভারতের কথা
রাত্রিকালে আকাশের উত্তর ভাগে সাতটি উজ্জ্বল তারা দেখিতে পাওয়া যায়, ইহাদিগকে ‘সপ্তর্ষি’ অর্থাৎ সাতমুনি বলে।
সাতটি মহামুনি সাতটি ভাই —ব্রহ্মার সাতটি পুত্র। সকল মুনির আগে এই সাত মুনি জন্মিয়াছিলেন। তখন জীবজন্তুর জন্ম হয় নাই। এই সাত মুনির নাম—
মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরাঃ, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু আর বশিষ্ঠ।
বশিষ্ঠের পুত্র শক্তি, শক্তির পুত্র পরাশর, পরাশরের পুত্র মহামুনি ব্যাস। ব্যাসদেবের মৃত্যু নাই, বিশ্বসংসারে কোন বিষয়ই তাঁহার অজানা নাই। যাহা কিছু হইয়াছে, যাহা কিছু হইতেছে, আর যাহা কিছু হইবে সকলই তিনি জানেন।
সাধারণ মানুষের চক্ষু আছে, তথাপি তাহারা অন্ধের ন্যায় কাজ করে। ধর্ম-অধর্মের কথা, পাপ-পুণ্যের কথা, তাহাদিগকে না বলিয়া দিলে, তাহারা কেমন করিয়া বুঝিবে? ইহাদের কথা ভাবিয়া ব্যাসদেবের বড়ই দয়া হইল।
তাই তিনি সুন্দর ভাষায়, সুললিত ছন্দে অতি আশ্চর্য কবিতা রচনা করিয়া, জ্ঞান, ধর্ম, শাস্ত্র, ইতিহাস প্রভৃতির সার কথা সকলের পক্ষে সহজ করিয়া দিলেন। এই-সকল কবিতা রচনা করিয়া ব্যাসদেবের মনে এই চিন্তা হইল যে, এখন কি করিয়া তাঁহার শিষ্যদিগের পক্ষে ইহা শিক্ষা করার সুবিধা হয়।
ব্যাসের চিন্তার কথা জানিতে পারিয়া, ব্রহ্ম তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য, এবং লোকের উপকারের নিমিত্ত, তাঁহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ব্রহ্মাকে দেখিবামাত্র, ব্যাস নিতান্ত আশ্চর্য এবং ব্যস্ত হইয়া, তাঁহার বসিবার জন্য আসন দিয়া, জোড় হাতে তাঁহার নিকট দাঁড়াইয়া রহিলেন। তারপর ব্রহ্ম আসনে বসিয়া ব্যাসকেও বসিতে অনুমতি করিলে, তিনি আনন্দের সহিত তাঁহার নিকটে বসিয়া বিনীত ভাবে বলিলেন—
“ভগবান, আমি একখানি সুন্দর কাব্য রচনা করিয়াছি, ইহাতে বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষৎ, পুরাণ, ইতিহাস প্রভৃতির সার আছে। ধর্ম, অধর্ম আর সংসারের সকল কাজের উপদেশ আছে। পৃথিবী, চন্দ্র সূর্য, গ্রহ, তারা, নদ, নদী, সমুদ্র, পর্বত, গ্রাম, নগর, বন উপবনের বর্ণনা আছে। এমন কবিতা আমি রচনা করিয়াছি, কিন্তু ভগবন্, আমার এই-সকল কবিতা লিখিয়া দিবার উপযুক্ত একজন ভাল লেখক খুঁজিয়া পাইতেছি না।”
ব্রহ্মা বলিলেন, “বৎস, তুমি অতি মধুর কাব্য রচনা করিয়াছ। আর কোন কবিই এমন কাব্য লিখিতে পারিবে না। তুমি গণেশকে স্মরণ কর, তিনিই তোমার এই আশ্চর্য কাব্যের উপযুক্ত লেখক।”
এই কথা বলিয়া ব্রহ্মা চলিয়া গেলেন। তারপর গণেশকে স্মরণ করিবামাত্র, তিনি আসিয়া ব্যাসের নিকট উপস্থিত হইলে, ব্যাস তাঁহাকে যথেষ্ট সম্মান এবং আদর দেখাইয়া, বিনয় পূর্বক বলিলেন—
“হে গণপতি, আমি আমার মন হইতে বলিয়া যাইতেছি, আপনি কৃপা করিয়া আমার কাব্যখানি অবিকল লিখিয়া দিন।”