পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৪৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৮২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

কথাটা বিশেষ করিয়া জানা দরকার যে, দেবতা আর অসুরদিগের মধ্যে ভয়ানক শত্রুতা ছিল। অসুরেরা চাহিত যে, দেবতাদিগকে তাড়াইয়া দিয়া, তাহারাই স্বর্গের রাজা হইবে। দেবতাদেরও সর্বদাই এই চেষ্টা ছিল যে, কি করিয়া তাঁহারা অসুরদিগকে মারিয়া স্বর্গটাকে নিজের হাতে রাখিবেন।

 যখন ভাল কবিয়া সৃষ্টির কাজ আরম্ভ হয় নাই, তখন হইতেই দানবেরা দেবতাদিগকে জ্বালাতন করিতে আরম্ভ করিয়াছিল।

 ব্রহ্মা যখন সৃষ্টি আরম্ভ করেন, তখন তিনি একটা পদ্মের ভিতরে বাস করিতেন। তখন জল ছাড়া আর কিছুই ছিল না, সেই জলের উপরে নারায়ণ অনন্ত শয্যায়[১] নিদ্রা যাইতেছিলেন। সে সময়ে নারায়ণের নাভি হইতে একটি পদ্ম বাহির হয়, তাহারই ভিতরে ব্রহ্মার বাসা ছিল। ইহার মধ্যে কখন নারায়ণের হাত হইতে দুই বিন্দু জল আসিযা, সেই পদ্মের উপরে পড়ে। তাহা দেখিয়া নাবায়ণ বলেন—

 “এই দুই বিন্দু জল হইতে দুইটা দৈত্য বাহির হউক।”


মধুকৈটভের কথা

 এ কথা বলিবামাত্র, মধু আব কৈটভ নামক দুইটা ভয়ঙ্কর দৈত্য, গদা হাতে সেই দুই বিন্দু জলের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল। ব্রহ্মা তখন অন্য জিনিস সৃষ্টি করিবার আগে, সবেমাত্র বেদ কখানি প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। দুষ্ট দানবগণ তাহা দেখিবামাত্র, ব্রহ্মার হাত হইতে বেদের পুঁথি কাড়িয়া লইয়া, ঝুপ করিয়া জলে লাফাইয়া পড়িল। তারপর সেই জলের ভিতরে ডুব সাঁতার দিয়া, তাহারা একেবারে পাতালে গিয়া বসিয়া রহিল।

 এদিকে বেদ হারাইয়া ব্রহ্মার দুঃখ আর-আক্ষেপের সীমা পরিসীমা রহিল না। তিনি আর উপায় না দেখিয়া, নিতান্ত কাতর ভাবে নারায়ণকে বলিলেন—“ভগবন্, মধু আব কৈটভ যে বেদ কাড়িয়া নিল, এখন উপায় কি হইবে? বেদ না হইলে ত সৃষ্টি করাই অসম্ভব দেখিতেছি!”

 সুতরাং নারায়ণের আর নিদ্রা হইল না। তিনি সেই মুহূর্তেই উঠিয়া, অতি ভীষণ হয়গ্রীব মূর্তি (অর্থাৎ সেই মূর্তির মাথা ঘোড়ার মতন ছিল) ধারণ পূর্বক, বেদ আনিবার জন্য পাতালে যাত্রা করিলেন।

 পাতালে উপস্থিত হইয়া নারায়ণ উচ্চৈঃস্বরে সুর করিয়া সাম বেদ গান করিতে লাগিলেন। সেই গানের শব্দ শুনিবামাত্রই মধুকৈটভ তাড়াতাড়ি বেদ ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দেখিতে চলিল, উহা কিসের শব্দ। সেই অবসরে নারায়ণ বেদ আনিয়া ব্রহ্মাকে দিয়া, হয়গ্রীব মূর্তি পরিত্যাগ করতঃ আবার ঘুমাইয়া রহিলেন। মধুকৈটভ ইহার কিছু জানিতে পারিল না।

 এদিকে মধু আর কৈটভ ‘কিসের শব্দ’ ‘কিসের শব্দ’ করিয়া পাতালময় খুঁজিয়া কিছুই দেখিতে পাইল না। তারপর ফিরিয়া আসিয়া দেখে, বেদও নাই! তখন তাহারা পাতাল হইতে উঠিয়া আসিয়া দেখিল, নারায়ণ নিদ্রা যাইতেছেন।


  1. অনন্ত একটি সাপ, তাহার এক হাজারটা মাথা। এই সাপের উপরে নাবায়ণ ঘুমাইতেছিলেন।