তাই দেবতারা পবিলেন, “হে কুর্মরাজ (কচ্ছপের রাজা)! তোমার পিঠে পর্বত রাখিয়া দাও!”
কুর্মরাজ বলিলেন, “এ আর কত বড় একটা কথা!”
কচ্ছপের রাজা তখনই গিয়া সমুদ্রের তলায় বসিলেন। তাঁহার পিঠের উপরে মন্দর পর্বত রাখা হইল। সেই পর্বতের চারিদিকে অনন্তকে জড়াইয়া দেওয়া হইল। তারপর দেবতারা ধরিলেন সাপের লেজ, অসুরেরা ধরিল তাঁহার মাথা, এইরূপ করিয়া তাঁহারা সেই পর্বতে এমনি বিষম পাক দিতে লাগিলেন যে, পাক যাহাকে বলে!
দেবতারা টানেন—হড়্-হড়্-হড়্-হড়্-হড়্-হড়্-হড়্-হড়্!!
অসুরেরা টানে—ঘড়্-ঘড়্-ঘড়্-ঘড়্-ঘড়্-ঘড়্-ঘড়্-ঘড়্-!!!
তাহাতে ত্রিভুবন কাঁপাইয়া ঘোরতর শব্দ উঠিল। পৃথিবী টলমল করিতে লাগিল। জল ছুটিয়া আকাশে উঠিল! মাছ মরিয়া গেল, পর্বতে আগুন ধরিয়া গেল।
তারপর, সেই পর্বতে যত ঔষধ, মণি, আর ধাতু ছিল; আগুনের তেজে তাহা গলিয়া সমুদ্রে পড়াতে, সমুদ্রের জল দুধ হইয়া গেল। সেই দুধ হইতে ঘি বাহির হইল।
এইরূপ করিয়া অনেকদিন চলিয়া গেল। দেবতারা ক্রমাগত পর্বতে পাক দিয়া দিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন, তখন যদি নারায়ণ তাঁহাদিগকে উৎসাহ না দিতেন, তবে তাঁহারা কখনই এ কাজ শেষ করিয়া উঠিতে পারিতেন না। নারায়ণের উৎসাহে নূতন বল পাইয়া, তাঁহারা আরো বেশি করিয়া পর্বতে পাক দিতে লাগিলেন।
এমন সময় হঠাৎ অতি কোমল এবং শীতল সাদা আলোতে চারিদিক উজ্জ্বল হইয়া গেল, আর তাহার সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রদেব তাঁহার সুন্দর গোল মুখখানি লইয়া হাসিতে হাসিতে সমুদ্রের ভিতর হইতে উঠিয়া আসিলেন।
তাঁহাকে দেখিয়া সকলে আশ্চর্য হইয়া গেলেন, কিন্তু তাঁহারা পাক দিতে ভুলিলেন না। চন্দ্র উঠিয়া সবে দেবতাদিগের নিকট গিয়া বসিয়াছেন, এমন সময় সেই ঘৃতের ভিতর হইতে একটি আশ্চর্য পদ্মফুল উঠিল। সেই পদ্মের ভিতরে লক্ষ্মীদেবী বসিয়াছিলেন, তাঁহার রূপের ছটায় ত্রিভূবন আলো হইয়া গেল!
লক্ষ্মীকে পাইয়া সকলে আনন্দের সহিত আরো বেশি করিয়া পাক দিতে লাগিলেন। তাহাতে সেই ঘৃতের ভিতর হইতে ক্রমে আরো তিনটি জিনিস বাহির হইল—একটি দেবতা, উচ্চৈঃশ্রবাঃ নামক একটি ঘোড়া, আর কৌস্তুভ নামক একটি মণি।
কৌস্তুভ মণিটি উঠিয়াই নারায়ণের বুকে গিয়া ঝুলিতে লাগিল। অন্য জিনিসগুলিও দেবতারাই পাইলেন।
এদিকে কিন্তু পাক থামে নাই। হড়্-হড়্-ঘড়্-ঘড়্ গভীর গর্জনে তাহা ক্রমাগতই চলিতেছিল। কিঞ্চিত পরে, শ্বেতবর্ণ কমণ্ডলু হাতে চিকিৎসার দেবতা ধন্বন্তরি সমুদ্রের ভিতর হইতে উঠিয়া আসিলেন। সেই কমণ্ডলুর ভিতরে অমৃত ছিল।
অমৃত দেখিবামাত্রই দৈত্যগণ, “উহা আমাদের” “উহা আমাদের” বলিয়া ঘোরতর কোলাহল আরম্ভ করিল।
মন্থন কিন্তু তখনো থামে নাই। তারপর ঐরাবত নামে একটা চার-দাঁতওয়ালা সাদা হাতি উঠিল। তাহাকে দেখিয়া ইন্দ্র বলিলেন, “ইহা আমার!” সুতরাং উহা তাঁহাকেই দেওয়া হইল।