স্কন্দের কথা
ঠিক এই সময়েই অগ্নি এবং স্বাহাদেবীর স্কন্দ নামক একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করিল। ইহার আর-এক নাম কার্তিকেয়। খোকাটি নিতান্তই অদ্ভুতরকমের, তেমন আর কেহ দেখেও নাই, শোনেও নাই। খোকার ছয়টি মাথা, বারটি চোখ, বারটি কান, বারটি হাত!
স্বর্গের সুন্দর শরবনে খোকাটিকে রাখিয়া, কৃত্তিকারা ছয়জনে মিলিয়া পরম স্নেহে তাহাকে পালন করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের যত্নে চারিদিনের ভিতরে সেই খোকা মস্ত হইয়া উঠিল। মহাদেব যে ধনুক দিয়া দানব মারিতেন, সেই বিশাল ধনুক হাতে লইয়া খোকা গর্জন করিল; ত্রিভুবনের ভিতরে কেহই সে গর্জন শুনিয়া স্থির থাকিতে পারিল না।
চিত্র ও ঐরাবত নামক ইন্দ্রের দুইটি হাতি সেই গর্জন শুনিয়া ছুটিয়া আসিয়াছিল। তাহাদিগকে দেখিয়া খোকা, দুই হাতে শক্তি এবং আর দুই হাতে তাম্রচূড় এবং কুক্কুট নামক দুইটি অস্ত্র লইয়া ঘোরতর গর্জন পূর্বক লাফাইতে লাগিল। আর দুই হাতে এই বড় একটি শাঁখ লইয়া ফুঁ দিল। আর দুই হাতে আকাশের খেলায় ধুপ্ ধাপ্ করিয়া বিষম চাপড় আরম্ভ করিল! তখন হাতির পুত্রেরা, লেজ খাড়া করিয়া, কোন্দিকে পলায়ন করিয়াছিল, তাহা আমি বলিতে পারি না।
তারপর স্কন্দ ধনুক হাতে লইয়া একটা তীর ছুঁড়িবামাত্র, তাহার ঘায় ক্রৌঞ্চ-পর্বতের মাথা উড়িয়া গেল।
সেকালের পর্বতগুলির প্রাণ ছিল। তাহারা পাখির মত উড়িতেও পারিত। স্কন্দের তাড়া খাইয়া যখন তাহারা সকলে মিলিয়া কাকের মতন চ্যাঁচাইতে আর উড়িতে আরম্ভ করিল, তখন না জানি ব্যাপারখানা কিরকম হইয়াছিল।
এদিকে দেবতাগণ ইন্দ্রকে বলিলেন, “হে দেবরাজ, এই খোকা বড় হইলে আপনার ইন্দ্রপদ কাড়িয়া লইবে। সুতরাং এই বেলা শীঘ্র ইহাকে বধ করুন৷”
ইন্দ্র বলিলেন, “দেবগণ আমার ত মনে হয় যে, এ খোকা ইচ্ছা করিলে বুঝি ব্রহ্মাকেও মারিয়া ফেলিতে পারে। এমত অবস্থায় আমি কি করিয়া ইহাকে বধ করিব?”
দেবতারা বলিলেন, “কেন? লোকমাতা সকলকে পাঠাইয়া দিলেই ত তাঁহারা ছেলেটিকে খাইয়া ফেলিতে পারেন৷”
‘লোকমাতা’ যাঁহাদের নাম, তাঁহাদের কাজ এমন নিষ্ঠুর হইবার কারণ কি? তাহা আমি বলিতে পারি না। যাহা হউক স্কন্দকে বধ বা ভক্ষণ করা দূরে থাকুক, তাঁহারা তাহার নিকট গিয়া বলিলেন, “বৎস, তোমাকে দেখিয়া আমাদের বড়ই স্নেহ হইয়াছে; তুমি আমাদিগকে মা বলিয়া ডাক৷”
তাহা দেখিয়া ইন্দ্র নিজেই অসংখ্য সৈন্য সমেত, ঐরাবতে চড়িয়া স্কন্দকে সংহার করিতে আসিলেন। কিন্তু স্কন্দ সৈন্য দেখিয়া, বা তাহাদের গর্জন শুনিয়া, ভয় পাইবার মতন খোকা নহেন। বরং তাঁহারই সিংহনাদ শুনিয়া সৈন্যদের মাথায় গোল লাগিয়া গেল! তারপর স্কন্দের মুখ হইতে আগুন বাহির হইয়া, সেই-সকল সৈন্যের ঢাল তলোয়ার আর দাড়ি গোঁফ পোড়াইতে আরম্ভ করিলে, তাহারা আর ইন্দ্রের দিকে না চাহিয়া, দুহাতে স্কন্দকেই সেলাম