পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫১৫

বলিলেন, “হে মহর্ষিগণ, আপনারা আমারই পূর্বপুরুষ। আমিই সেই দুরাত্মা হতভাগ্য জরৎকারু। আমার অপরাধের সীমা নাই। সেজন্য আমাকে উচিত শাস্তি দিন। আর বলুন, আমি কি করিব।”

 ইহাতে পূর্বপুরুষেরা বলিলেন, “তুমি বিবাহ কর।”

 জরৎকারু বলিলেন, “আচ্ছা, আমি বিবাহ করিব; কিন্তু ইহার মধ্যে দুইটি কথা আছে। মেয়েটির আমার নামে নাম হওয়া চাহি। আর বিবাহের পর স্ত্রীকে খাইতে দিতে পারিব না। ইহাতে যদি আমার বিবাহ জোটে, তবেই বিবাহ করিব, নচেৎ নহে।”

 এই বলিয়া জরৎকারু বিবাহের জন্য মেয়ে খুঁজিতে লাগিলেন। একে বুড়ো তাতে গরিব। স্ত্রীকে খাইতে পরিতে দিতে পরিবে না, কুঁড়ে ঘরখানি পর্যন্ত নাই, যে, তাহাতে নিয়া তাহাকে রাখিবে। এমন বরকে মেয়ে দিতে বোধহয় বাঘ ভালুকেও রাজি হয় না, মানুষ ত দূরের কথা। মুনি দেশ বিদেশে খুঁজিয়া হয়রান হইলেন, কোথাও মেয়ে পাইলেন না। তখন পূর্বপুরুষদের কথা মনে করিয়া, তাহার নিতান্ত কষ্ট হওয়াতে তিনি এক বনের ভিতর গিয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। কাঁদিতে কাঁদিতে তিনি বলিলেন, “এখানে যদি কেহ থাক, তবে শোন। আমি যাযাবর বংশের তপস্বী, নাম জরৎকারু। পুর্বপুরুষদিগের আজ্ঞায় আমি বিবাহ করিতে চাহিতেছি। কিন্তু কিছুতেই কন্যা জুটিতেছে না। যদি তোমাদের কাহারও নিকট কন্যা থাকে, আর যদি তাহার আমার নামে নাম হয়, আর যদি আমায় টাকা না দিতে হয়, আর মেয়েকেও খাইতে পরিতে দিতে না হয়, তবে নিয়া আইস, আমি তাহাকে বিবাহ করিব।”

 এদিকে হইয়াছে কি—বাসুকির লোকেরা সেই তখন হইতেই জরৎকারুকে খুঁজিতেছে, কিন্তু এত দিন কোথাও তাঁহার দেখা পায় নাই। জরৎকারু যখন সেই বনের ভিতরে ঢুকিয়া কাঁদিতেছিলেন, তখন বাসুকির ঐ-সব লোকের কয়েকজন সেখানে ছিল। তাহারা তাঁহার কথা শুনিয়াই বলিল, ঐ রে সেই মুনি। ঐ শোন, সে বিবাহ করিতে চায়! শীঘ্র কর্তাকে খবর দিই গিয়া চল।”

 এই বলিয়া তাহারা বায়ুবেগে ছুটয়া গিয়া বাসুকিকে এই সংবাদ দিল। বাসুকিও সে সংবাদ পাওয়া-মাত্রই তাহার ভগিনীকে অতি সুন্দর পোশাকে এবং বহুমূল্য অলঙ্কার পরাইয়া জরৎকারুর নিকট উপস্থিত করিলেন। তাহাকে দেখিয়া জরৎকারু বলিলেন—

 “মহাশয়, ইঁহার নামটি কি?”

 বাসুকি বলিলেন, “ইঁহার নাম জরৎকারু।”

 জরৎকারু বলিলেন, “বেশ! কিন্তু আমি ত টাকাকড়ি দিতে পারিব না।”

 বাসুকি বলিলেন, “আপনাকে কিছুই দিতে হবে না। আমি অমনিই মেয়ে দিতেছি।”

 জরৎকারু বলিলেন, “বেশ। বেশ! কিন্তু মেয়েকে খাইতে পরিতে দিবে কে? আমার ত কিছুই নাই।”

 বাসুকি বলিলেন, “তাহার জন্য আপনার কোন চিন্তা নাই। আমি ইহাকে চিরকাল ভরণ পোষণ করিব (খাওয়াইব পরাইব)।”

 জরৎকারু বলিলেন, “তবে ভাল, আমি ইহাকে বিবাহ করিব। কিন্তু যদি ইনি কখনো আমাকে অসন্তুষ্ট করেন, তবে আমি তখনই চলিয়া যাইব।”