আনন্দের ব্যাপার হইয়াছিল, তাহা কাগজে লেখার চেয়ে চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে অনেক মিষ্ট লাগে।
শকুন্তলা যত কষ্ট পাইয়াছিলেন, দুষ্মন্তের আদরে তাহার সমস্ত ভুলিয়া গেলেন। সর্বদমন যুবরাজ হইলেন, আর তাঁহার ‘সর্বদমনের’ বদলে ‘ভরত’ নাম হইল। ইহার পরেও তিনি সিংহ আর বাঘ লইয়া খেলা করিতেন কি না তাহা আমি শুনিতে পাই নাই! কিন্তু তিনি যে রাজাদিগের সকলকেই পরাজয় করিয়াছিলেন, এ কথা মহাভারতে স্পষ্ট লেখা আছে। আমাদের এই দেশের নাম যে ভারতবর্ষ তাহা এই ভরত হইতেই হইয়াছে।
এই গল্পে যে দুর্বাসার শাপ এবং আংটির ঘটনার কথা আছে, তাহা মহাভারতে নাই। কালিদাসের শকুন্তলায় এই সকল ঘটনা আছে।
চ্যবন ও সুকন্যার কথা
ভৃগুর পুত্র মহর্ষি চ্যবনের তপস্যার কথা অতি আশ্চর্য। তিনি বনের ভিতরে একটি সরোবরের ধারে এক আসনে বসিয়া কত কাল যে তপস্যা করিতেছিলেন, তাহ কেহই বলিতে পারিত না। তাঁহার শরীর ধুলায় ঢাকিয়া গেল, সেই ধূলার উপর গাছপালা হইল, সেই গাছে পিঁপড়ের বাসা হইল;তথাপি তাঁহার তপস্যার শেষ হইল না। শেষে এমন হইল যে তাঁহাকে দেখিলে মনে হইত ঠিক যেন একটি উইয়ের ঢিপি। লোকে সেই উইঢিপিকে অত্যন্ত ভক্তি করিত। তাহদের পিতামহের পিতামহেরা উঁহাদের পূর্বপুরুষগণের নিকট শুনিয়াছিলেন যে, সেই উইঢিপির ভিতরে মহামুনি চ্যবন তপস্যা করিতেছেন।
এইরূপে অনেক কাল গেল। তারপর একদিন মহারাজ শর্যাতি, অনেক লোকজন সঙ্গে লইয়া সপরিবারে সেই সরোবরের ধারে বনভোজন করিতে আসিলেন। ছোট ছোট মেয়েদের অনেকেই আর কখনো বনের শোভা দেখে নাই। তাই এরকম জায়গায় এত গাছ আর ফুল দেখিয়া তাহদের অতিশয় আনন্দ হইল। “এটা কিসের গাছ?” “ওটা কি ফুল?” “এ ফল কি খায়?” “ও গাছে কি হয়?” ক্রমাগত এই-সব কথা জিজ্ঞাসা করিয়া তাহারা সঙ্গের লোকদিগকে এমনি ব্যস্ত করিয়া তুলিল যে, ব্যস্ত যাহাকে বলে।
রাজার একটি কন্যা ছিলেন, তাঁহার নাম সুকন্যা। মেয়েটি বড়ই বুদ্ধিমতী, আর তাহার মনটি অতিশয় সরল। আর দেখিতে তিনি এমনই সুন্দর যে, তেমন আর দেখা যায় না। বাপ মায়ের একমাত্র সন্তান, কাজেই বড় আদরের মেয়ে, আর সেইজন্যই তাঁর স্বভাবটি একটু একগুঁয়ে —একটু ঝোঁকের মাথায় কাজ করেন। কিন্তু তাঁর মনটি বড় ভালো।
রাজকন্যা সখীদিগকে লইয়া বনের শোভা দেখিতে দেখিতে সেই উইয়ের টিপির নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মুনির ধ্যান তখন সবে শেষ হইয়াছে, আর তিনি চক্ষু মেলিয়া চাহিয়াছেন আর চাহিয়াই তিনি দেখিলেন, সম্মুখে এক রাজকন্যা। দেবতার মতন রূপ, আর দেবতার মতন পবিত্র মনের জ্যোতি তাঁহার মুখে ফুটিয়া উঠিয়াছে।
রাজকন্যাকে দেখিবামাত্রই মুনির মন স্নেহে গলিয়া গেল। তাঁহার বড়ই ইচ্ছা হইল, কন্যার পরিচয় গ্রহণ করেন; আর দুটি মিষ্ট কথা তাঁহকে বলেন। কিন্তু বহুকালের অনাহারে