পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫৩৫

তাহার কণ্ঠ একেবারেই শুকাইয়া গিয়াছিল— তাহাতে কথা সরিল না।

 উইয়ের ঢিপি দেখিয়া রাজকন্যার আশ্চর্যের সীমা রহিল না। এমন অদ্ভুত পদার্থ তিনি আর কখনো দেখেন নাই, সুতরাং তাঁহার মনে হইল, ‘এ জিনিসটাকে একটু ভালো করিয়া ঘাঁটিয়া দেখিতে হইবে।’ এই ভাবিয়া সেই উইঢিপির খুব কাছে গিয়া, সুকন্যা দেখিলেন যে, তাহাতে দুটি ছোট ছোট কি জিনিস ঝক ঝক করিতেছে।

 ইহার একটু আগে, বনের ভিতরে একটি গাছে খুব লম্বা লম্বা কাঁটা দেখিতে পাইয়া রাজকন্যা, তামাশা দেখিবার জন্য, তাহার একটা সঙ্গে লইয়াছিলেন। উইঢিপিতে দুটো চকচকে জিনিস দেখিয়া তিনি, “বাঃ! এগুলো আবার কিরে?” বলিয়া সেই কাঁটা দিয়া তাহাতে খোঁচা মারিলেন।

 সেই চকচকে জিনিস দুটি আর কিছুই নয়। উহা চ্যবনের চোখ। সমস্ত শরীর মাটি চাপা পড়িয়া কেবল উঁহার ঐ চোখ দুইটি জাগিয়া ছিল। দেখিতে উহা দুটি চকচকে পাথরের মতনই দেখা যাইতেছিল, সুকন্যা স্বপ্নেও ভাবিতে পারেন নাই যে, উহা আবার কোনো মানুষের চোখ হইতে পারে।

 যাহা হউক, মুনির বড়ই লাগিল, তাহাতে আর ভুল নাই। তিনি যে লাফাইয়া উঠেন নাই, তাহা কেবল মাটির চাপনে। চ্যাঁচান নাই যে, সে কেবল গলা শুকাইয়া যাওয়াতে। আর, সুকন্যাকে যে শাপ দেন নাই কেন, তাহা আমি ঠিক করিয়া বলিতে পারিতেছি না।

 কিন্তু তাঁহার বড়ই রাগ হইয়াছিল। তাই তিনি রাজার সৈন্যদিগের এমনি অদ্ভুত রকমের এক অসুখ উপস্থিত করিয়া দিলেন যে, বলিতে গেলে তাহা তেমন সাংঘাতিক অসুখ কিছু নয়, অথচ তাহারা ভয়ে আর অসুবিধায় পাগলের মত হইয়া উঠিল।

 হঠাৎ এমন আশ্চর্য ব্যাপার উপস্থিত দেখিয়া রাজা ত নিতান্তই চিন্তিত হইলেন। কিন্তু তিনি ইহার কারণ কিছুই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিলেন না। শেষে তিনি সৈন্যদিগকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা ত সেই উইঢিপির ভিতরের মুনিঠাকুরকে কোনরকমে অমান্য কর নাই।” সৈন্যগণ জোড়হাতে বলিল, “মহারাজ, আমরা তাঁহার অমান্য করিব দূরে থাকুক, আমরা কেহ ঐদিক্ দিয়া যাই-ই নাই। আপনি নাহয় তাঁহার নিকট গিয়া বিনয়ের সহিত ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করুন।”

 রাজা আর সৈন্যদিগের কথাবার্তা শুনিয়া সুকন্যা বুঝিতে পারিলেন যে, ঐ ঢিপির ভিতরে একজন তপস্বী আছেন, তখন তাঁহার মনে হইল যে, সেই চকচকে জিনিস দুটাতে খোঁচা মারাতেই বা কোনরূপ দোষ ঘটিল। সুতরাং তিনি তখনই রাজার নিকট গিয়া একটু দুঃখিত ভাবে বলিলেন, “বাবা আজ বেড়াইবার সময় আমি ঐ ঢিপিটাতে দুটা চকচকে জিনিস দেখিতে পাইয়া তাহাতে কাঁটা দিয়া খোঁচা মারিয়াছিলাম।”

 ইহার পর আর রাজার বুঝিতে বাকি রহিল না যে, কিসে সর্বনাশ হইয়াছে। তিনি তৎক্ষণাৎ যার পর নাই ব্যস্ত হইয়া সেই ঢিপির নিকট ছুটিয়া চলিলেন, আর জোড়হাতে চ্যবনকে বলিলেন, “ভগবন্‌, আমার কন্যা না জানিয়া আপনাকে কষ্ট দিয়াছে তাহাকে ক্ষমা করুন।”

 চ্যবন বলিলেন, “মহারাজ, তোমার মেয়ে আমার চোখে যে খোঁচা মারিয়াছে, তাহার পর আর কিছুতেই উহাকে ক্ষমা করা যাইতেছে না। তোমার সেই সুন্দরী পাগলী মেয়েটিকে আমি বিবাহ করিব, তবে ছাড়িব।”