পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৪৫

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
মহাভারতের কথা
৫৪৫

কেহ তাঁহাকে দেখিতে পাইল না। চাকর-চাকরানীরা তাঁহার চারিদিক দিয়া যাওয়া আসা করিতে লাগিল, কেহই বুঝিতে পারিল না যে, একজন লোক আসিয়াছে। শেষে যখন একেবারে দময়ন্তীর নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন দময়ন্তী আর তাঁহার সখীরা তাঁহাকে দেখিতে পাইলেন। তাঁহারা মনে করিলেন, বুঝি কোন দেবতা আসিয়াছেন। তাই তাঁহারা তাঁহাকে নমস্কার করিয়া, হেঁট মুখে তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলেন, কোন কথা কহিলেন না।

 তখন দময়ন্তীর মন বলিল, “ইনিই মহারাজা নল।’ এ কথা মনে হইবামাত্র তাঁহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইয়া গেল। তিনি বলিলেন, “মহারাজ কি করিয়া এখানে আসিলে? দরজায় যে পাহারা।”

 নল বলিলেন, “দেবতাদের বরে তোমার লোকেরা আমাকে দেখিতে পায় নাই। ইন্দ্র, যম, অগ্নি আব বরুণ আমাকে তাঁহাদের দূত করিয়া তোমার নিকট পাঠাইয়াছেন; তুমি তাঁহাদের মধ্যে একজনকে বরণ কর।”

 দময়ন্তী বলিলেন, “মহারাজ, হাঁসের মুখে তোমার কথা শুনিয়াছিলাম, সেই হইতে তোমাকে ভালোবাসিয়াছি। তোমা ছাড়া আমি আর কাহাকেও বিবাহ করিতে পারিব না। তুমি যদি আমাকে পরিত্যাগ কর, তবে আমি বিষ খাইয়া মরিব।”

 নল বলিলেন “রাজকুমারি, দেবতাদিগের পায়ের ধূলার সমানও আমি নহি। তাঁহাদিগকে ছাড়িয়া আমাকে কেন বিবাহ করিতে চাহিতেছ? মনে করিয়া দেখ, ইঁহারা অসন্তুষ্ট হইলে কি না করিতে পারেন।”

 দময়ন্তী বলিলেন, “দেবতাদিগের মহিমার অন্ত নাই; তাঁহাদিগকে নমস্কার করি! কিন্তু মহাবাজ, আমি সত্য বলিতেছি, তোমাকে ছাড়িয়া আমি আর কাহাকেও বিবাহ করিতে পারিব না।”

 নল বলিলেন, “দময়ন্তি, আমিও তোমাকে বড়ই ভালোবাসি। কিন্তু যাঁহাদের দূত হইয়া আসিয়াছি, তাঁহাদিগকে ছাড়িয়া নিজের কথা বলিলে আমার মহাপাপ হইবে।”

 দময়ন্তী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “মহারাজ, তোমার কাজ ত তুমি ভালো মতই করিযাছ। ইহার পরেও যদি আমি ত্রিভূবনের সম্মুখে তোমার গলায় মালা দিই, তাহাতে তোমার কেন পাপ হইবে? মহাবাজ, তুমি সভায় আসিবে; আমি তোমাকেই বরণ করিব।”

 রাজা দেবতাদের নিকট চলিয়া আসিলেন। দেবতারা জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ, দময়ন্তী কি বলিল?”

 নল বলিলেন, “আমি আপনাদের কথা আমার সাধ্যমত বলিয়াছি। তথাপি দময়ন্তী বলিলেন, আমার গলাতেই মালা দিবেন। এখন আপনাদের যাহা ভালো মনে হয় করুন।”

 স্বয়ম্বরের শুভদিন আসিয়া উপস্থিত হইল। সুন্দর সভাঘর আলো করিয়া দেবতা আর রাজাগণ, মাণিকের কাজ করা সোনার সিংহাসনে বসিলে, সে স্থানের শোভার আর সীমা রহিল না। তারপর সন্ধ্যার আকাশে যেমন চন্দ্র দেখা দেয়, দময়ন্তী স্নিগ্ধ উজ্জ্বল মনোহর বেশে সেইরূপ আসিয়া সভায় দাঁড়াইলেন। তখন ঘটকেরা মালা চন্দন পরিয়া, মধুর স্বরে অতি চমৎকার ভঙ্গিতে রাজাগণের পরিচয় দিতে আরম্ভ করিল। দময়ন্তী সকলের কথাই শুনিলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না, তিনি কেবল চারিদিক চাহিয়া দেখিতেছিলেন, নল কোথায়!

উপেন্দ্র—৬৯