উতঙ্ক
বেদের আর একটি শিষ্য ছিলেন, তাঁহার নাম উতঙ্ক। একবার বেদ উতঙ্কের উপর সংসার দেখিবার ভার দিয়া বিদেশে গেলেন। উতঙ্ক অতিশয় বুদ্ধিমান এবং ধার্মিক লোক ছিলেন। গুরু বিদেশে থাকার সময় তিনি এমন সুন্দর করিয়া তাঁহার সংসারের কাজ চালাইলেন যে, অল্প লোকেই তেমন করিতে পারে। বেদ বিদেশ হইতে ফিরিয়া দেখিলেন, উতঙ্ক কোন বিষয়েই কোনরূপ ত্রুটি করেন নাই। বরং কোন কোন কঠিন বিষয়ে আশ্চর্যরূপ বিবেচনার সহিত কাজ করিয়াছেন। ইহাতে তিনি যার পর নাই আহ্লাদিত হইয়া বলিলেন, “বৎস উতঙ্ক, তোমার ব্যবহারে আমি বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছি। তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হউক তুমি সকল বিদ্যা লাভ করিয়া সুখে গৃহে গমন কর।”
গুরুর কথা শুনিয়া উতঙ্ক বিনয়ের সহিত বলিলেন, “ভগবন্, আমি আপনাকে কিঞ্চিৎ দক্ষিণা দিতে প্রার্থনা করি। আমি শুনিয়াছি যে, বিদ্যা লাভ করিয়া দক্ষিণা না দিলে গুরুরও অনিষ্ট হয়, শিষ্যেরও অনিষ্ট হয়। অতএব, কিরূপ দক্ষিণা আনিব, অনুমতি করুন।”
বেদ বলিলেন, “আচ্ছা, আর-এক সময় বলিব।”
তারপর বেদ দক্ষিণার কথা ভুলিয়া গেলেন। তাহা দেখিয়া উতঙ্ক আর-একদিন তাঁহাকে বলিলেন, “গুরুদেব, কিরূপ দক্ষিণা আনিব অনুমতি করুন।”
বেদ সাধাসিধা মানুষ। তিনি হয়ত উতঙ্কের ব্যবহারেই যথেষ্ট দক্ষিণা পাইয়াছেন মনে করিয়াছিলেন, তাই তাহার কথা তিনি ভাবেন নাই। উতঙ্ক দক্ষিণা দিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতেছে দেখিয়া তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত কিঞ্চিৎ দক্ষিণা লওয়া তাঁহার উচিৎ মনে হইল, কিন্তু কি চাহিবেন ঠিক করিতে পারিলেন না। শেষে বলিলেন, “তোমার উপাধ্যায়ানীকে (গুরুপত্নীকে) বল। তিনি যাহা চাহেন সেই দক্ষিণ আনিয়া দাও।”
তখন উতঙ্ক উপাধ্যায়ানীর নিকট গিয়া বলিলেন, “মা, গুরুদেব আমাকে গৃহে যাইতে অনুমতি দিয়াছেন। আমি কিছু দক্ষিণা দিয়া যাইতে চাহি, অনুমতি করুন কি আনিব।”
উপধ্যায়ানী বলিলেন, “বাছা, মহারাজ পৌয্যের রানী যে দুটি আশ্চর্য কুণ্ডল পরেন সেই কুণ্ডল দুটি আমাকে আনিয়া দাও। আর তিনদিন পরে একটা ব্রত হওয়ার কথা আছে। সেদিন খুব ঘটা করিয়া ব্রাহ্মণ-ভোজন হইবে; সেইদিন ঐ কুণ্ডল পরিয়া আমি পরিবেশন করিতে চাহি। তাহার পূর্বে কুণ্ডল আনিয়া দিতে পারিলেই তোমার মঙ্গল নচেৎ কষ্ট পাইবে।”
উতঙ্ক তখন কুণ্ডল আনিতে যাত্রা করিলেন। খানিক দূর গিয়া তিনি দেখিলেন যে, একজন অতি প্রকাণ্ড পুরুষ এক বিশাল ষাঁড়ের উপর চড়িয়া, পথের মাঝখানে দাঁড়াইয়া আছে। প্রকাণ্ড পুরুষ উতঙ্ককে সেই ষাঁড়ের গোবর দেখাইয়া বলিলেন, “উতঙ্ক, তুমি উহা আহার কর।”
এ কথায় উতঙ্ক নাক মুখ সিঁটকাইয়া বলিলেন, “ওয়াক্! থু! আমি তাহা পারিব না।”
তাহাতে প্রকাণ্ড পুরুষ বলিলেন, “ভয় পাইও না! তুমি নিশ্চিন্তে আহার কর। তোমার গুরুও একবার উহা খাইয়াছিলেন।”