প্রবেশ করিলেন। অনেক শূকর আর হরিণ বধ হইলে, তাহাতে রাজারও নিতান্ত পরিশ্রম আর পিপাসা হইল। নিকটে মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রম ছিল; জল খাইবার জন্য রাজা সেই আশ্রমে গিয়া উপস্থিত হইলেন।
রাজাকে পরম সমাদরপূর্বক বসিতে আসন দিয়া, মহামুনি মিষ্ট বাক্যে তাঁহার কুশল জিজ্ঞাসা করতঃ কহিলেন, “মহারাজ, কিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া আমাকে তুষ্ট করুন।”
জলযোগের আয়োজন ভালো করিয়াই হইল। বশিষ্ঠের ধন জন ছিল না; তাঁহার ছিল কেবল নন্দিনী নামে একটি আশ্চর্য গরু। গাইটি অতি সুন্দরী। পাঁচ হাত চওড়া; ছয় হাত উঁচু; চক্ষু দুটি ব্যাঙের ন্যায়;শরীরটি নধর;পা চারিখানি অতি নিটোল;লেজটি আর শিং দুটি বড়ই চমৎকার; আর বাঁটগুলি যেন অমৃতের ভাণ্ড। মুনি যাহা চাহিতেন, নন্দিনীর নিকট তাহাই পাইতেন।
রাজার জলযোগের কথা শুনিয়া নন্দিনী দধি, দুগ্ধ, ক্ষীর, সর, মিঠাই, মণ্ডায় হাজার হাজার হাঁড়ি পরিপূর্ণ করিয়া দিলেন;মহামুল্য বস্ত্র আর অলঙ্কার সিন্দুকে আনিয়া উপস্থিত করিলেন। রাজা পাত্রমিত্র সহিত পরিতোপূর্বক ভোজন করিয়া, মনে ভাবিলেন, ‘একি আশ্চর্য ব্যাপার।
গরুটিকে বারবার দেখিয়াও রাজার সাধ মিটিল না;তিনি মুনিকে বলিলেন, “ঠাকুর, আমি দশকোটি গরু, আর আমার সমুদয় রাজ্য দিতেছি আপনার গাইটি আমাকে দিন্।”
বশিষ্ঠ বলিলেন, “মহারাজ, নন্দিনী আমার সকল ধর্মকর্মের একমাত্র উপায়;আমি নন্দিনীকে দিতে পারিব না।”
বিশ্বামিত্র বলিলেন, “আপনি সহজে না দিলে, আমি জোর করিয়া গাই লইয়া যাইব।”
বশিষ্ঠ বলিলেন, “আপনার বল বিক্রম অনেক আছে; আপনি যাহা ইচ্ছা করেন, তাহাই করিতে পারেন।”
রাজার লোকজন অনেক ছিল;তাহারা আজ্ঞামাত্র নন্দিনীকে বাঁধিয়া লইয়া চলিল। নন্দিনী মুহূর্তের মধ্যে সেই বাঁধন ছিঁড়িয়া, তাহাদের শত প্রহার সত্ত্বেও হাম্বা হাম্বা শব্দে বশিষ্ঠের নিকট আসিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। রাজার লোকেরা তাড়া খাইয়াও তিনি আশ্রম ছাড়িলেন না। তাহা দেখিয়া বশিষ্ঠ নিতান্ত দুঃখের সহিত বলিলেন, “মা, তোমার কাতর হাম্বারব শুনিয়া আমার বড়ই দুঃখ হইতেছে। কিন্তু বিশ্বামিত্র তোমাকে জোর করিয়া লইয়া যাইতেছে আমি ক্ষমাশীল ব্রাহ্মণ, কি করিব?”
নন্দিনী বলিলেন, “ভগবন্, রাজার লোকেদের নিষ্ঠুর প্রহারে অনাথার ন্যায় কাতর ভাবে কাঁদিতেছি। এমন সময় কেন আপনি আমার দিকে চাহিতেছেন না?”
বশিষ্ট অনেক কষ্টে স্থির থাকিয়া বলিলেন, “মা ক্ষত্রিয়ের বল তেজ, আর ব্রাহ্মণের বল ক্ষমা। সুতরাং আমি কি করিতে পারি? তোমার যদি ইচ্ছা হয়, তবে তুমি যাও।”
নন্দিনী বলিলেন, “হে ভগবন্, আপনি যদি আমাকে পরিত্যাগ না করেন, তবে কেহই জোর করিয়া আমাকে নিতে পারিবে না।”
বশিষ্ঠ বলিলেন, “মা, আমি কি ইচ্ছা করিয়া তোমাকে পরিত্যাগ করিতে পারি? তোমার যদি ক্ষমতা থাকে, তবে আমার কাছেই থাক। ঐ দেখ, তোমার বাছুরটিকে বাঁধিয়া নিতেছে!”
তখন রাগে নন্দিনীর দুই চোখ লাল হইয়া উঠিল; আর তিনি অতি ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ