পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫৮৭

পূর্বক, ঘাড় উঁচু করিয়া শিং নাড়িতে নাড়িতে, ঘোরতর হাম্বা হাম্বা শব্দে রাজার সৈন্যদিগকে তাড়া করিলেন। তাহারা তাঁহাকে আটকাইবার জন্য কত চেষ্টা করিল, লাঠি দিয়া তাঁহাকে কতই মারিল; কিন্তু তাহাতে কাতর হওয়া দূরে থাকুক, বরং তাঁহার রাগ শতগুণে বাড়িয়া গেল। সে সময়ে তাঁহার শরীর সুর্যের ন্যায় জ্বলিতেছিল। আর তাহার ভিতর হইতে পহ্নব, দ্রাবিড়, শক, যবন, কিরাত, কাঞ্‌চী, শরভ, পৌণ্ড্র, সিংহল, বর্বর, বশ, চিবুক, পুলিন্দ, চীন, কেরল প্রভৃতি অসংখ্য জাতীয় বিকটাকার সৈন্য কত যে বাহির হইতেছিল, তাহার সীমা সংখ্যা নাই। তাহাদের কাহারো ঝাঁটার মতন গোঁফ দাড়ি;কাহারো নেড়া মাথায় লম্বা টিকি; কাহারো গায়ে মুখে বিচিত্র উল্কি; কাহারো ঝাঁকড়া চুলে পালক গোঁজা; কেহ ঝোল্লা পরা পাগড়ি আঁটা।

 এই-সকল সৈন্য বিশ্বমিত্রের লোকদের কোন অনিষ্ট করিল না। কিন্তু ইহাদের তীক্ষ্ণ অস্ত্র, ভয়ঙ্কর ভূকুটি, বিষম দাঁতখিঁচুনি আর উৎকট গর্জনের ভয়েই সে বেচারারা প্রাণভয়ে পিতামাতার নাম লইয়া পলায়ন করিল। নন্দিনীর সৈন্যেরা তাহাদিগকে অনেক দূর অবধি তাড়া করিয়াছিল, কিন্তু দয়া করিয়া তাহাদের একটিরও প্রাণ বধ করে নাই।

 এই আশ্চর্য ব্যাপার দেখিয়া বিশ্বামিত্রের মন বড়ই খারাপ হইয়া গেল।

 তিনি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন যে, ক্ষত্রিয়ের বল কিছুই নহে, ব্রাহ্মণের বলই যথার্থ বল; তপস্বীরা তপস্যা দ্বারা যাহা করিতে পারেন, রাজা তাঁহার রাজ্য, সম্মান, ধন জন লইয়া তাহার কিছুই করিতে পারেন না।

 এইরূপ চিন্তায় রাজ্য আর ধনের উপরে বিশ্বামিত্রের এতই ঘৃণা জন্মিয়া গেল যে, তিনি চিরদিনের মত তাহা পরিত্যাগপূর্বক বনে গিয়া ঘোরর তপস্যা আরম্ভ করিলেন। সে যে কি কঠোর তপস্যা, তাহা আমি কি বলিব? তেমন তপস্যা আর কেহ করিয়াছে কি না সন্দেহ। এই তপস্যার জোরে শেষে তিনি ব্রাহ্মণ হইয়া ইন্দ্রের সহিত সোমরস পান করিয়াছিলেন।

 ইহার পর হইতে বিশ্বামিত্র খুব বড় একজন মুনি হইলেন, আর তখন হইতেই নানা উপায়ে বশিষ্ঠকে ক্লেশ দিতে লাগিলেন। বিশ্বামিত্রের তপস্যার বল অসাধারণ ছিল, আর বশিষ্ঠকে তিনি যে দুঃখ দিয়াছিলেন, তাহাও অসাধারণ, তাহাতে সন্দেহ নাই।

 সরস্বতী নদীর তীরে স্থানু নামক তীর্থ। সেই তীর্থের নিকটে সরস্বতীর পূর্বাধারে বশিষ্ঠের ও পশ্চিম কূলে বিশ্বামিত্রের আশ্রম। বশিষ্ঠ সরস্বতীর তীরে বসিয়া তপস্যা করেন, সেই আশ্চর্য তপস্যা দেখিয়া বিশ্বামিত্রের বড়ই হিংসা হয়। একদিন বিশ্বামিত্র মনে ভাবিলেন, “বশিষ্ঠ যখন নদীর ধারে বসিয়া জপ করে, তখন এই নদীকে দিয়া উহাকে আমার নিকট আনাইয়া, উহার প্রাণ বধ করিব।”

 এই মনে করিয়া তিনি অতিশয় ক্রোধ ভরে নদীকে স্মরণ করিবামাত্র, নদী ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া করজোড়ে বলিলেন, “ভগবন্‌, আমাকে কি করিতে হইবে, অনুমতি করুন।”

 বিশ্বামিত্র ভ্রূকুটি করিয়া রাগের সহিত বলিলেন, “শীঘ্র বশিষ্ঠকে এইখানে লইয়া আইস; আমি তাহাকে বধ করিব।”

 এ কথা শুনিয়া সরস্বতী ভয়ে কাঁপিতে লাগিলেন। তাহা দেখিয়া বিশ্বামিত্র বলিলেন, “তোমার কোন ভয় নাই;শীঘ্র বশিষ্ঠকে এখানে লইয়া আইস।”