শক্তি মিষ্টভাবে বলিলেন, “মহারাজ! এ ত আমারই পথ; কেন না, শাস্ত্রে আছে, রাজা সকলের আগে ব্রাহ্মণদিগকে পথ ছাড়িয়া দিবেন।”
এইরূপে দুজনে পথ লইয়া এমনি তর্ক আরম্ভ হইল যে, শেষে রাজা রাগে অস্থির হইয়া শক্তিকে চাবুক মারিতে লাগিলেন। ইহাতে শক্তিও ক্রোধভরে রাজাকে এই বলিয়া শাপ দিলেন, “তুমি যেমন রাক্ষসের মত ব্যবহার করিতেছ, তেমনি তুমি রাক্ষসই হও।”
সেইখান দিয়া তখন বিশ্বামিত্রও যাইতেছিলেন, এবং আড়ালে থাকিয়া শক্তি আর কল্মাষপাদের কলহ দেখিতেছিলেন। শক্তি কম্মাষপাদকে ‘রাক্ষস হও’ বলিয়া শাপ দিবামাত্র বিশ্বামিত্র কিঙ্কর নামক একটি রাক্ষসকে সেখানে দেখিতে পাইয়া, তাহাকে কল্মাষপাদের শরীরে ঢুকাইয়া দিলেন।
কল্মাষপাদ শক্তির শাপে ভয় পাইয়া বিনীত ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছেন, এমন সময় রাক্ষস তাহার ভিতরে প্রবেশ করাতে হঠাৎ তাঁহার মাথা খারাপ হইয়া গেল। তখন তিনি আর ক্ষমা প্রার্থনা না করিয়া, সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন। পথে এক ব্রাহ্মণ তাঁহার নিকট মাংস চাহিলেন, রাজা তাঁহাকে বলিলেন, “একটু বসুন, মাংস আনিতেছি।”
বাড়ি আসিয়া রাজার সমস্ত দিনের ভিতরে এ কথা মনেই হইল না। দুই প্রহর রাত্রিতে হঠাৎ তাহার চৈতন্য হইলে, তিনি তাড়াতাড়ি পাচককে ডাকিয়া ব্রাহ্মণের নিকট মাংস ভাত পাঠাইতে বলিলেন। কিন্তু চাকর অনেক খুঁজিয়াও মাংস পাইল না। রাজার ভিতরে রাক্ষস; তাহার বুদ্ধিসুদ্ধিও এতক্ষণে রাক্ষসের মতই হইয়া গিয়াছে। তাই তিনি পাচককে ধমক দিয়া বলিলেন, “কেন? শ্মশানে কত মানুষ পড়িয়া আছে, তাহার মাংস আনিয়া রাঁধ না।” পাচক রাজার আজ্ঞায় তাহাই করিল; আর সেই মানুষের মাংসের ব্যঞ্জন আর ভাত ব্রাহ্মণের নিকট পাঠাইয়া দেওয়া হইল। ব্রাহ্মণ অতিশয় তেজীয়ান তপস্বী ছিলেন, তিনি সেই মাংস দেখিবামাত্র সকল কথা জানিতে পারিয়া “রাক্ষস হও” বলিয়া রাজাকে শাপ দিলেন।
শক্তির শাপেই রাজার স্বভাব ক্রমে রাক্ষসের মত হইয়া আসিতেছিল। তাহার উপর ব্রাহ্মণ এইরূপ শাপ দেওয়াতে রাজা একেবারেই ক্ষেপিয়া গিয়া দাঁত কড়মড় করিতে করিতে ছুটিয়া বাহির হইলেন। খানিক দূরে গিয়াই তিনি দেখিলেন, তাঁহার সম্মুখে, শক্তি! অমনি আর কথাবার্তা নাই—“তবে রে বামুন, তুই-ই না আমাকে রাক্ষস হইতে বলিয়াছিলি? আয় তোকেই আগে খাই!” এই বলিয়া তিনি মুহূর্তের মধ্যে শক্তির ঘাড় ভাঙ্গিয়া তাঁহাকে খাইয়া ফেলিলেন।
বিশ্বামিত্র যে রাজার দেহে রাক্ষস প্রবেশ করাইয়াই নিশ্চিন্ত ছিলেন এমন নহে। তিনি ক্রমাগতই সংবাদ লইতে ছিলেন, ইহার পর কি হয়। যেই তিনি দেখিলেন, রাজা শক্তিকে খাইয়াছে, অমনি তিনি বশিষ্ঠের আর নিরানব্বইটি পুত্রকেও খাইবার জন্য সেই রাক্ষসকে লেলাইয়া দিলেন। সিংহ যেমন শিকার ধরিয়া খায়, মুনির ইঙ্গিত পাইবামাত্র রাক্ষস সেইরূপ করিয়া শক্তির নিরপরাধ ভাই গুলিকে একে একে চিবাইয়া খাইল।
এই দারুণ সংবাদ যখন বশিষ্ঠদেব শুনিতে পাইলেন, তখন তিনি সামান্য মানুষের ন্যায় ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন না। শোক ত তাঁহার হইয়াছিলই, সে শোকের আমরা কি বুঝিব? কিন্তু এমন শোক পাইয়াও তিনি এমন কথা বলিলেন না, ‘আমার শত্রুর কোনরূপ অনিষ্ট হউক।’ অথচ তিনি ইচ্ছা করিলেই বিশ্বামিত্রকে সবংশে সংহার করিতে পারিতেন। এমন ক্ষমতা