পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৯০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

তাঁহার ছিল।

 সেই ভীষণ শোকের আগুনে পুড়িয়া বশিষ্ঠদেবের হৃদয় যেন একেবারে ছাই হইয়া গেল, ইহার পর আর এই অন্ধকার, শূন্য সংসারে একদিনও বাঁচিয়া থাকিতে তাঁহার ইচ্ছা হইল না। দেহ ত্যাগ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া তিনি মেরু পর্বতের চূড়া হইতে লাফাইয়া পড়িলেন। কিন্তু এমন মহাপুরুষের এভাবে মৃত্যু হয়, ইহা ভগবানের ইচ্ছা ছিল না। তিনি বশিষ্ঠের দেহ তুলার মত হাল্‌কা করিয়া দিলেন, আর বশিষ্ঠ তুলার মত হাওয়ায় ভাসিতে ভাসিতে অতিশয় আরামের সহিত আস্তে আস্তে নামিয়া আসিলেন।

 দেহে একটি আঘাত বা আঁচড় পর্যন্ত লাগিল না। মৃত্যু কেমন করিয়া হইবে? তখন বশিষ্ঠদেব ভাবিলেন, ‘ঐ বনের ভিতরে প্রচণ্ড দাবানল জ্বলিতেছে, উহাতে প্রবেশ করিয়া প্রাণত্যাগ করিব!’

 বশিষ্ঠদেব ছুটিয়া আগুনের ভিতরে গেলেন। কিন্তু ভগবানের কৃপায় তাহার পূর্বেই আগুন হিমের ন্যায় শীতল হইয়া গিয়াছিল, তাহাতে বশিষ্ঠের দেহ পুড়িল না। এইরূপে বশিষ্ঠদেব কোন মতেই মরিতে না পারিয়া আশ্রমে ফিরিয়া আসিলেন। কিন্তু সেই শ্মশানের মত শূন্য আশ্রম দেখিবামাত্র, তাঁহার প্রাণত্যাগের ইচ্ছা দ্বিগুন বাড়িয়া উঠিল, তিনি আবার সেখান হইতে ছুটিয়া বাহির হইলেন।

 বর্ষাকাল, নদীতে বান ডাকিয়াছে, জলের স্রোতে গাছ পাথর সকল ভাঙ্গিয়া কল কল শব্দে ছুটিয়া চলিয়াছে। বশিষ্ঠ ভাবিলেন, ‘এই নদীতে ঝাঁপ দিয়া মরিব।’ এই মনে করিয়া তিনি নিজের হাত পা বাঁধিয়া নদীতে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন। কিন্তু নদী তাঁহাকে তল না করিয়া, পরম যত্নে তীরের দিকে লইয়া চলিল, খরতর স্রোত তাঁহার পাশ (অর্থাৎ বাঁধন) কাটিয়া দিল। তাই মহর্ষি তীরে উঠিয়া নদীর নাম রাখিলেন ‘বিপাশা’।

 তারপর ‘হায়! আমার কি কিছুতেই মৃত্যু হইবে না?’ বলিয়া বশিষ্ঠদেব সংসারময় ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। শেষে তিনি অতি ভয়ঙ্কর কুম্ভীর পরিপূর্ণ হৈমবতী নদীর তীরে আসিয়া মনে করিলেন, ‘ইহার জলে নামিলে নিশ্চয়ই কুমিরেরা আমাকে সংহার করিবে।’

 কিন্তু সেই মহাপুরুষ নিকটে আসিবামাত্রই নদী শতভাগ হইয়া পলায়ন করিল। তাঁহার প্রাণত্যাগ করা হইল না। এইজন্য এখনো লোকে সেই নদীকে ‘শতদ্রু’ বলিয়া থাকে।

 তখন বশিষ্ঠ বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার মৃত্যু হওয়া ভগবানের ইচ্ছা নহে, সুতরাং তিনি আশ্রমের দিকে ফিরিয়া চলিলেন। এমন সময় তাঁহার পুত্রবধূ (শক্তির স্ত্রী) অদৃশ্যন্তী দেবীও তাঁহাকে খুঁজিতে খুঁজিতে আসিয়া পিছন হইতে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন। বশিষ্ঠদেব সে কথা জানিতে পারেন নাই। তাহার মনে হইল যেন, কেহ তাঁহার পিছন হইতে অতি চমৎকারভাবে বেদ পাঠ করিতেছে। ইহাতে মহর্ষি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কে, আমার পশ্চাতে আসিতেছ?’

 অদৃশ্যন্তী বলিলেন, ‘ভগবন্‌, আমি তপস্বিনী অদৃশ্যন্তী, আপনার পুত্রবধূ।’

 মহর্ষি বলিলেন, ‘মা, এমন সুন্দর করিয়া কে বেদ পাঠ করিতেছে? আহা, আমার শক্তির মুখে যেমন শুনিতাম, মনে হইতেছে যেন ঠিক সেইরূপ।’

 অদৃশ্যন্তী বলিলেন, ‘বাবা, এটি আপনার নাতি, জন্মিবার পূর্বেই সে বেদ পড়িতে শিখিয়াছে।’