এমন নাতির কথা শুনিয়া স্নেহে এবং আনন্দে বশিষ্ঠের হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া গেল। তখন তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, সংসারে এখনো তাঁহার অনেক কর্তব্য রহিয়াছে, তাহার জন্য তাঁহার বাঁচিয়া থাকা প্রয়োজন। সুতরাং তিনি পরম স্নেহে অদৃশ্যন্তীকে সঙ্গে লইয়া, তাড়াতাড়ি আশ্রমের দিকে চলিলেন।
পথে একটা গভীর বন। সেই বনের ভিতরে রাক্ষস রাজা কল্মাষপাদ শুইয়াছিলেন। বশিষ্ঠ আর অদৃশ্যন্তীকে দেখিয়াই রাক্ষস তাঁহাদিগকে খাইবার জন্য ছুটিয়া আসিতে লাগিল। ইহাতে অদৃশ্যন্তী বড়ই ভয় পাইতেছে দেখিয়া, বশিষ্ঠ তাঁহাকে বলিলেন, ‘মা, কোন ভয় নাই।’
এই বলিয়া তিনি রাক্ষসকে এক ধমক দিবামাত্র, সে থমকিয়া দাঁড়াইল। তারপর তিনি মন্ত্র পড়িতে পড়িতে তাহার গায় খানিকটা জল ছড়াইয়া দিতেই, তাহার শাপ দূর হইয়া গেল।
এইরূপে শাপ হইতে রক্ষা পাইয়া, কল্মাষপাদ যার পর নাই ভক্তি এবং বিনয়ের সহিত বশিষ্ঠকে প্রণাম করিলে, বশিষ্ঠ বলিলেন, ‘মহারাজ, এখন রাজধানীতে গিয়া রাজ্য শাসন কর, আর কখনো ব্রাহ্মণের অপমান করিও না।’
রাজা লজ্জিত হইয়া বলিলেন, ‘ভগবন্, আমি আর কখনো এমন কাজ করিব না।’
তারপর কল্মাষপাদ অনেক মিনতি করিয়া বশিষ্ঠকে অযোধ্যায় লইয়া গেলেন। সেখানকার লোকেরা মহর্ষির যে কত সম্মান, কত স্তব স্তুতি করিল, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না।
বশিষ্ঠদেব তাঁহার পৌত্রটির নাম পরাশর রাখিলেন। পরাশর পিতাকে চক্ষে দেখেন নাই, তিনি মনে করিতেন, বুঝি বশিষ্ঠই তাঁহার পিতা। জন্মাবধি তিনি বশিষ্ঠের সঙ্গে সঙ্গেই থাকিতেন, আর তাঁহাকেই পিতা বলিয়া ডাকিতেন।
পরাশর যখনই বশিষ্ঠকে পিতা বলিয়া ডাকিতেন, তখনই শক্তির কথা মনে হইয়া অদৃশ্যন্তীর চক্ষে জল পড়িত। একদিন তিনি পরাশরকে কোলে লইয়া, তাঁহার মুখে চুমো খাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, ‘বাছা, আমার শ্বশুর ত তোমার পিতা নহে, তিনি তোমার পিতামহ।’
পরাশর তাঁহার উজ্জ্বল চোখ দুটি বড় করিয়া মার মুখের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘তবে আমার পিতা কোথায় গিয়াছেন?’
অদৃশ্যন্তী অনেক কষ্টে স্থির থাকিয়া বলিলেন, ‘তিনি স্বর্গে চলিয়া গিয়াছেন’ এ কথায় পরাশর বলিলেন, ‘মানুষ ত মরিয়া গেলেই স্বর্গে যায়, আমার পিতা কি করিয়া মরিয়া গেলেন?’
অদৃশ্যন্তী বলিলেন, ‘এক রাক্ষস তাঁহাকে মারিয়া ফেলিয়াছিল।’
পিতার এমনভাবে মৃত্যু হইয়াছিল, এ কথা শুনিয়া পরাশর রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, ‘আমি সৃষ্টি নষ্ট করিব।’