চ্যবনের মূল্য
মহর্ষি চ্যবন প্রয়াগ তীর্থে দীর্ঘকাল তপস্যা করিয়াছিলেন। এই পবিত্র তীর্থে গঙ্গা এবং যমুনার মিলনের স্থান। সেই স্থানে, গঙ্গা এবং যমুনার জলের মধ্যে কাষ্ঠের ন্যায় স্থিরভাবে বসিয়া, মহর্ষি চ্যবন ক্রমাগত বার বৎসর একমনে একাসনে কেবল ভগবানের চিন্তা করেন। এতদিন জলের মধ্যে স্থির ভাবে থাকায়, তাঁহার দেহ শ্যাওলায় আর শামুকে ঢাকিয়া গিয়াছিল। মাছেরা আশ্চর্য হইয়া দলে দলে তাঁহাকে দেখিতে আর শুঁকিতে আসিত, এবং কিছুমাত্র ভয় না পাইয়া তাঁহার চারিদিকে খেলা করিত। মহর্ষি এসকল ব্যাপারের কোন সংবাদ না লইয়া মনের সুখে ঈশ্বর-চিন্তায় সময় কাটাইতেছেন।
এমনি করিয়া বার বৎসর কাটিয়া গেল। তারপর একদিন কোথা হইতে অসুরের মত জেলেসকল আসিয়া, বিশাল জগৎ-বেড় জালে সে স্থান ঘিরিয়া ফেলিল।
মাছ, কচ্ছপ, কুমির প্রভৃতি যত জন্তু নদীতে ছিল, সকলেই সেই জালে ধরা পড়িল, কেহই তাহা এড়াইতে পারিল না।
তারপর সেই প্রকাণ্ড জালকে টানিয়া ডাঙ্গায় তুলিবামাত্র জেলেরা দেখিল যে সেইসকল মাছের সঙ্গে একটি অদ্ভুতরকমের মুনিও সেই জালে ধরা পড়িয়াছেন। তাঁহার সমস্ত শরীর, এমন-কি, দাড়ি আর জটা পর্যন্ত শ্যাওলায় সবুজ হইয়া গিয়াছে, অসংখ্য শামুক, ডুমুরের ফলের ন্যায় তাঁহার দেহে লাগিয়া রহিয়াছে।
মুনিকে দেখিয়া জেলেরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপিতে তাঁহাকে বারবার নমস্কার করিতে লাগিল। কিন্তু চ্যবন তাহাদিগকে কিছুই বলিলেন না। মাছ-গুলিকে জল হইতে তুলিয়া আনাতে তাহারা খাবি খাইতেছিল। তাহাদের কষ্ট দেখিয়া তিনি মনের দুঃখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন। তাহা দেখিয়া জেলেরা জোড়হাতে বিনয় করিয়া বলল, “ভগবান, আমরা না জানিয়া অপরাধ করিয়াছি আমাদিগকে ক্ষমা করুন, আর এখন আমরা আপনার কি প্রিয় কার্য করিতে পারি, তাহারও অনুমতি করুন।”
চ্যবন বলিলেন, “বাপুসকল! আমি এই মৎস্যগণের সহিত বহুকাল বাস করিয়াছি, এখন কিছুতেই ইহাদিগকে ছাড়িতে পারিব না। আমি হয় ইহাদের সঙ্গে প্রাণত্যাগ করি, না হয় তোমরা আমাকে ইহাদের সহিত বিক্রয় কর।”
মহর্ষির কথায় নিষাদগণ যার পর নাই ভয় পাইয়া, নিতান্ত দুঃখের সহিত মহারাজ নহুষের নিকট গিয়া উপস্থিত হইল। রাজা তাহাদের নিকট মুনির সংবাদ পাইবামাত্র, তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া, তাঁহাকে প্রণাম এবং অশেষ রূপ সমাদর পূর্বক জোড়হাতে বলিলেন, “ভগবন্ কি অনুমতি হয়?”
চ্যবন বলিলেন, “মহারাজ! এই জেলে বেচারারা বড়ই পরিশ্রম করিয়াছে। তুমি উহাদিগকে উহাদের মৎস্যের এবং আমার মূল্য প্রদান কর।”
রাজা বলিলেন, “আপনার অনুমতি হইল আপনার মূল্যস্বরূপ সহস্র মুদ্রা ইহাদিগকে দেওয়া যাউক।”