পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৬২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৬২৭

করিল। তারপর, সম্মুখে সেই মূর্তি, হাতে ধনুর্বান, আর হৃদয়ে অটল প্রতিজ্ঞা, এইরূপে সে ভগবানকে স্মরণ পূর্বক আশ্চর্য অধ্যবসায়ের সহিত অস্ত্র অভ্যাস আরম্ভ করিল।

 এইরূপে অনেকদিন চলিয়া গেল। ইহার মধ্যে একদিন পাণ্ডব এবং কৌরব মৃগয়া করিবার জন্য রথারোহণ পূর্বক সেই বনে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদের একজন সঙ্গে করিয়া একটি কুক্কুরও আনিয়াছিলেন। রাজপুত্রেরা মৃগের সন্ধানে বনে প্রবেশ করিলে, সেই কুক্কুর স্বভাব-দোষে চঞ্চলভাবে ছুটিয়া বেড়াইতে লাগিল। সে স্থান হইতে একলব্যের আশ্রম বেশি দূরে ছিল না। কুকুরটি ঝোপে ঝোপে উঁকি মারিয়া আর গাছে গাছে শুঁকিয়া ক্রমে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হয়, আর একলব্যকে দেখিবামাত্র সে নিতান্ত ব্যস্ত হইয়া ঘেউ ঘেউ করিতে থাকে। ইহাতে একলব্যের অতিশয় অসুবিধা বোধ হওয়াতে, সে একবারে সাতটি শর মারিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিয়া দিল।

 রাজপুত্রেরা শিকারে ব্যস্ত, এমন সময় কুকুরটি নিতান্ত জড়সড় ভাবে তাঁহাদের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। বেচারার লেজ প্রাণপণে গুটান, মুখে শরের ছিপি আঁটা, ঘেউ ঘেউ করিবার শক্তি নাই! অন্তরে আতঙ্কের অবধি নাই, তাহার সেই অবস্থা দেখিয়া রাজপুত্রগণের বিস্ময়ের সীমা রহিল না। বিশেষত, এমন করিয়া তাহার মুখে সেই আশ্চর্য ছিপি কে আঁটিল, এই কথা ভাবিয়া তাঁহারা একেবারে অবাক হইয়া গেলেন। সে ব্যক্তি যে ধনুর্বিদ্যায় তাঁহাদের সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তাহা স্পষ্টই বুঝা গেল, কেননা, তাঁহাদের কাহারো এমন অদ্ভুত কাজ করিবার শক্তি ছিল না।

 সুতরাং রাজপুত্রদের আর শিকার করা হইল না। তাহার পরিবর্তে, এখন সেই অসাধারণ বীরকে খুঁজিয়া বাহির করাই হইল তাঁহাদের প্রধান কাজ। অনেকক্ষণ বনে বনে অনুসন্ধান করিয়া, শেষে তাঁহারা দেখিলেন যে, এক বিশাল দেহ জটাধারী কৃষ্ণবর্ণ পুরুষ এক মনে কেবলই শর নিক্ষেপ করিতেছে। তাহারা ইহাতে অতিশয় আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?”

 সে বলিল, “আমি নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র, এবং দ্রোণাচার্যের শিষ্য। আমার নাম একলব্য।”

 ইহার পূর্বে রাজপুত্রদিগের যেমন আশ্চর্য বোধ হইয়াছিল, একলব্য দ্রোণাচার্যের শিষ্য এ কথা শুনিয়া তাঁহাদের তেমনই অভিমান হইল। সুতরাং তাঁহারা আর বিলম্ব না করিয়া সেখান হইতে একেবারে দ্রোণের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “গুরুদেব, আমাদের কি অপরাধ হইয়াছে, যে, আপনি আমাদিগকে ছড়িয়া, নিষাদ পুত্র একলব্যকে এমন চমৎকার শিক্ষা দান করিলেন?”

 এ কথায় দ্রোণ ত নিতাই আশ্চর্য হইয়া গেলেন। তিনি অনেক ভাবিয়াও এই ব্যাপারের কোন অর্থ বুঝিতে পারিলেন না। সুতরাং তিনি বলিলেন, “বৎসগণ, আমি ত ইহার কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। এই ব্যক্তি কেমন করিয়া আমার শিষ্য হইল, আমিই বা কখন ইহাকে শিক্ষা দিলাম, তাহা ভাবিয়া আমি অবাক হইতেছি, চল, ইহার বিশেষ অনুসন্ধান করিতে হইবে।”

 তখনই সকলে মিলিয়া পুনরায় একলব্যের নিকট আসিলেন। একলব্য দূর হইতে দ্রোণকে দেখিতে পাইয়াই “গুরুদেব” বলিয়া ছুটিয়া গিয়া তাঁহার পায়ে পড়িল। তাহার পর তাঁহাকে