পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৬৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৬৪৩

 কিন্তু ‘প্রত্যুৎপন্নমতি তখনো জীবনের আশা একেবারে ছাড়িল না। সে ভাবিল, যাহা হয় হইবে, একবার ত প্রাণ বাঁচাইবার চেষ্টা করিয়া দেখি।’ এই মনে করিয়া সে চুপিচুপি জেলেদের সেই দড়িতে গাঁথা মাছগুলির মধ্যে ঢুকিয়া এমনভাবে দড়িটা কামড়াইয়া রহিল যে, দেখিলে মনে হয়, ঠিক যেন সে তাহাতে গাঁথা রহিয়াছে। কাজেই জেলেরা আর তাহাকে গাঁথিবার চেষ্টা করিল না। অন্য যত মাছ সেই পুকুরে ছিল, তাহাদের সবগুলিকেই —এবং তাহাদের সঙ্গে বেচারা দীর্ঘসূত্রকেও—তাহারা দড়িতে গাঁথিয়া লইল।

 যখন জেলেরা মনে করিল যে, সকল মাছ গাঁথা হইয়াছে, তখন সেই কাদা মাখা মাছগুলিকে ধুইয়া পরিষ্কার করিবার জন্য তাহারা আর একটা পুকুরে লইয়া গেল। সেই পুকুরটা ছিল খুব বড়, আর তাহাতে জলও ছিল ঢের। সেই বড় পুকুরের গভীর জলে, জেলেরা মাছ সুদ্ধ তাহাদের দড়ি ডুবাইবামাত্র, প্রত্যুৎপন্নমতি সেই দড়ি ছাড়িয়া ছুট দিল।

 এক বাঁচে সাবধান, আর বাঁচে বুদ্ধিমান। এ সংসারে অসতর্ক বোকার বড়ই বিপদ।


ইঁদুর আর বিড়ালের কথা

 কোন এক বনে বহুকালের পুরাতন এক প্রকাণ্ড বটগাছ ছিল। সেই বটগাছে গোড়ায় পলিত নামে একটি অতিশয় বুদ্ধিমান ইঁদুর শতমুখ বিশিষ্ট সুন্দর গর্তে বাস করিত। ঐ গাছের ডালে কত পাখির বাসা ছিল, তাহার সংখ্যা নাই। লোমশ নামে এক দুষ্ট বিড়াল, সেই-সকল পাখির ছানা খাইবার জন্য, সেই গাছে থাকিত।

 ইহার মধ্যে পরিঘ নামক এক বিকটাকার ব্যাধ সেই বনে আসিয়া কুঁড়ে বাঁধিল। সে প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে, ঐ গাছের নিকটে ফাঁদ পাতিয়া মাংসের টুকরা ছড়াইয়া রাখিত, আর সকালে আসিয়া দেখিত, তাহাতে অনেক জন্তু ধরা পড়িয়াছে। একদিন সেই ফাঁদে পাখিরছানা-খেকো দুষ্ট বিড়ালটা আটকা পড়িল।

 ইঁদুরটিরও বড়ই ইচ্ছা হইত যে, সেই টুকটুকে মাংসের একটু খানি চাখিয়া দেখে। কিন্তু দুরন্ত বিড়াল গাছের আড়াল হইতে ক্রমাগতই তাহাকে ধরিবার চেষ্টায় থাকাতে আর তাহার সে সাধ মিটাইবার সুযোগ হইত না। আজ সেই শত্রু ফাঁদে পড়িয়াছে, সুতরাং ইদুরের বড়ই আনন্দ। সে ফাঁদের নিকটে আসিয়া মনের সুখে মাংস খাইতে লাগিল; বিড়ালকে গ্রাহ্যই করিল না।

 এমন সময় সেই ইঁদুরের গন্ধ পাইয়া, হরিত নামক একটা অতি ভীষণ এবং নিতান্ত নিষ্ঠুর নেউল তাহাকে খাইবার জন্য, ঠোঁট চাটিতে চাটিতে আসিয়া গর্তের ভিতর হইতে উকি মারিল। তাহার সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রক নামে সাক্ষাৎ মৃত্যুর ন্যায় ভয়ঙ্কর একটা প্যাঁচা, গাছের উপর হইতে তাহার উপর ছো ঁমারিবার আয়োজন করিল। সেই নেউলের রাঙা রাঙা চোখ, আর প্যাঁচার সাংঘাতিক ঠোট আর নখ দেখিয়া, ইঁদুর বেচারার ত আর ভয়ের সীমা পরিসীমা রহিল না। সে তখন এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিল যে, এখন কি করিয়া এই বিষম বিপদ হইতে রক্ষা পাই? একমাত্র এই বিড়াল এখন আমাকে বাঁচাইতে পারে, সুতরাং ইহার সহিত বন্ধুতা করা নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে।