কহিয়া শান্ত করিতে পার কিনা।”
শিবের কথায় ব্রহ্মা মুনি-ঋষিদিগকে লইয়া গণেশকে শান্ত করিতে গেলেন। গণেশ তাহাকে দেখিয়া ভাবিলেন, বুঝি ভূত আসিয়াছে, কাজেই বুঝিতেই পার—ব্রহ্মার মুখে যত দাড়ি ছিল, সব তিনি ছিড়িয়া ফেলিলেন। ব্রহ্মা যত চ্যাঁচান, “দোহাই বাবা, আমাকে মারিও না, আমি যুদ্ধ করিতে আসি নাই” গণেশ ততই আরো বেশি করিয়া তাহার দাড়ি ছিঁড়েন। তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া শেষে দরজার হুড়কা লইয়া তাঁহাকে তাড়া করিলেন। তখন আর কাহারও সেখানে থাকিতে ভরসা হইল না, সকলে ঊর্ধ্বশ্বাসে শিবের নিকট গিয়া উপস্থিত হইল। তারপর সকল দেবতা আর ভূত মিলিয়া গণেশের সঙ্গে যে যুদ্ধ করিল, সে বড়ই ভীষণ।
পার্বতী দেখিলেন যে গণেশের বড়ই বিপদ উপস্থিত, এখন আর শুধু লাঠি হুড়কা লইয়া যুদ্ধ করিলে চলিবে না, তাই তিনি দুইটা ভয়ংকর শক্তি তয়ের করিয়া গণেশকে দিলেন।
তাহার একটার মুখ এমনি বিকট যে সে হাঁ করিলে পাহাড় পর্বত গিলিয়া ফেলিতে পারে। আর একটা বিজুলীর মতো ঝলমল করে, আর তাহার যে কত হাজার হাত তাহা গণিয়া শেষ করা যায় না। সেই দুই শক্তি দেবতাদের সকল অস্ত্র গিলিয়া ফেলিতে লাগিল, কাজেই গণেশের গদার সামনে তাঁহাদের কেহই টিকিতে পারিলেন না। দেবতা আর ভূত সকলকেই পলাইয়া প্রাণ বাঁচাইতে হইল। তাঁহারা কত যুদ্ধ করিয়াছেন আরো কত যুদ্ধ দেখিয়াছেন, কিন্তু এমন বিপদে আর কখনো পড়েন নাই। তখন শিব আর বিষ্ণু পরামর্শ করিলেন যে এই ছেলেটাকে ছল করিয়া মারিতে না পারিলে আর উপায় নাই। বিষ্ণু শিবকে বলিলেন, “আমি সম্মুখ হইতে যুদ্ধ করিয়া ইহাকে ভুলাইয়া রাখিব। সেই সময় তুমি পিছন হইতে ইহার প্রাণ বধ করিবে।”
এই বলিয়া বিষ্ণু মায়ার বলে গণেশের শক্তি দুটিকে অবশ করিয়া দিলেন; কিন্তু গণেশ তাহাতে ভয় না পাইয়া এমনি গদা ছুঁড়িয়া মারিলেন যে তাহা সামলাইতে বিষ্ণু অস্থির। তাহা দেখিয়া শিব মহারাগে ত্রিশূল হাতে লইলেন। কিন্তু গণেশের গদার ঘায়ে তাহা তাঁহার হাত হইতে পড়িয়া গেল। তাহাতে তিনি পিনাক (শিবের ধনুক) হাতে নিলেন, তাহাও গণেশের গদার ঘায়ে পড়িয়া গেল, আর সেই অবসরে গণেশ তাঁহার পাঁচখানি হাত কাটিয়া ফেলিলেন। তারপর গণেশ আবার বিষ্ণুকে গদা ছুঁড়িয়া মারিলেন, কিন্তু বিষ্ণুর চক্রে ঠেকিয়া তাহা গুঁড়া হইয়া গেল। এমনি করিয়া যেই গণেশ আবার বিষ্ণুর সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত হইয়াছেন, অমনি শিব পিছন হইতে আসিয়া ত্রিশূল দিয়া তাঁহার মাথা কাটিয়া ফেলিলেন।
হায়। এই নিদারুণ শোক পার্বতী কিরূপে সহ্য করিবেন? তিনি রাগে আর দুঃখে অস্থির হইয়া এক হাজারটা এমন ভয়ংকল্প শক্তি তয়ের করিলেন যে, তাহারা দেখিতে দেখিতে সকল সৃষ্টি নাশ করিবার যোগাড় করিল। শিবের কোমর ভাঙ্গিয়া দিল, অন্য দেবতাদিগকে মারিয়া ফেলিতে লাগিল। সে যে কী ভীষণ কাণ্ড তাহা আর বলিবার নয়।
তখন শুধু আর হাতজোড় ভিন্ন উপায় কি, কিন্তু পার্বতীর কাছে আসিতে কাহারও ভরসা হয় না, তাই দূরে থাকিয়াই দেবতাগণ প্রাণপণে সে কাজ করিতে লাগিলেন। অনেক কান্নাকাটির পর শেষে পার্বতী তাঁহাদিগকে বলিলেন, “আচ্ছা গণেশকে যদি বাঁচাইয়া দাও, আর সকল দেবতার আগে তাহার পূজা হয়, তবে আমি তাহাদিগকে ক্ষমা করিব।”