লাথি মারিব।” ছায়াও তখন রাগে অস্থির হইয়া বলিল, “বটে? এত বড় আস্পর্দা? তোর ঐ পা খসিয়া পড়ুক।”
শাপের ভয়ে যম কাঁদিতে কাঁদিতে সূর্যের নিকট গিয়া নালিশ করিল, “বাবা, মা আমাদের ভালোবাসেন না বলিয়া আমি তাঁহাকে পা দেখাইয়াছিলাম, তাহাতে তিনি বলিয়াছেন, আমার পা খসিয়া পড়িয়া যাইবে। বাবা আমি তো লাথি মারি নাই, তুমি আমার পা খসিয়া পড়িতে দিয়ো না।” সূর্য বলিলেন, “বাবা, তোমার মা যখন শাপ দিয়াছেন, তখন তো আর তাহা আটকাইবার উপায় নাই। তবে, এইটুকু করা যাইতে পারে যে পোকায় তোমার পায়ের মাংস অল্পে অল্পে লইয়া যাইবে, আস্ত পা খসিয়া পড়ার দরকার হইবে না।”
তারপর সূর্যদেব ছায়ার নিকট গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি মা হইয়া ছেলের সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন করিতেছ?” ছায়া প্রথমে চুপ করিয়া রহিল কিন্তু তারপরই যখন সূর্য বিষম রাগের ভরে তাঁহার চুল ধরিয়া শাপ দিবার আয়োজন করিলেন, তখন আর সে না বলিয়া যায় কোথায়?
সেকথা শুনিয়া সূর্য যে কিরূপ ব্যস্তভাবে তাঁহার শ্বশুরের নিকট ছুটিয়া আসিলেন, তাহা কি বলিব। বিশ্বকর্মা দেখিলেন, ঠাকুর বড় বেজায় রকমের চটিয়াছে, তাঁহার মুখ দিয়া ভালো করিয়া কথাই বাহির হইতে পারিতেছে না। তখন তিনি তাঁহাকে অনেক মিষ্টকথায় শান্ত করিয়া বলিলেন, “ঠাকুর জানেন তো আপনার তেজ কি ভয়ংকর। আমার মেয়ে সে তেজ কিছুতেই সহিতে না পারিয়া ভয়ে পলায়ন করিয়াছে। তবে, আপনি যদি চাহেন তো আপনার এই তেজ আমি অনেকটা কমাইয়া দিতে পারি। তাহা হইলে সংজ্ঞারও আপনার নিকট থাকিতে কষ্ট হইবে না। আর আপনার চেহারাটাও অনেক মোলায়েম হইয়া যাইবে।”
সূর্য বাস্তবিকই সংজ্ঞাকে অতিশয় ভালোবাসিতেন। কাজেই তিনি তৎক্ষণাৎ বিশ্বকর্মার কথায় রাজি হইলেন। বিশ্বকর্মা আর দেরি না করিয়া তাড়াতাড়ি ঠাকুরকে কুঁদে চড়াইয়া দিলেন। আগেই বলিয়াছি, সূর্য সে সময়ে তেমন গোল ছিলেন না। কুঁদে চড়াইয়া সোঁ সোঁ শব্দে কয়েক পাক দিতেই তাহার উষ্কশুষ্ক কিরণগুলি বাটালির মুখে উড়িয়া গেল আর তাহার ভিতর হইতে তাহার ঐ সুন্দর গোল মুখখানি দেখা দিল, তখন সকলেই বলিল, “বাঃ, বেশ হইয়াছে। এখন ঠাকুর যেমন ঠাণ্ডা, তেমনি দেখিতে ভালো।”
এ কথায় সূর্যদেব যারপরনাই সন্তুষ্ট হইয়া সংজ্ঞাকে খুঁজিতে বাহির হইলেন। তিনি শুনিয়াছিলেন, সংজ্ঞা ঘোটকী সাজিয়া উত্তরদিকে পলায়ন করিয়াছেন। কাজেই তাঁহাকে কোন দিকে যাইতে হইবে তাহা আর বুঝিতে বাকি রহিল না। সংজ্ঞা সাজিয়াছিলেন ঘোটকী, তিনি সাজিলেন ঘোড়া। তারপর সেই যে সেখান হইতে তিনি চিঁ-হিঁ হিঁ হিঁ শব্দে ছুট দিলেন আর একেবারে সংজ্ঞার সম্মুখে উপস্থিত না হইয়া থামিলেন না। কিন্তু সংজ্ঞাকে তিনি সহজে ধরিতে পারেন নাই, কারণ সে বেচারী কি করিয়া জানিবেন যে ঐ যে চিঁ-হিঁ হিঁ হিঁ শব্দে ঘোড়াটি ছুটিয়া আসিতেছে সেই হইতেছে তাঁহার স্বামী? কাজেই তিনি তাহাকে দেখিয়া প্রাণপণে ছুটিয়া পলাইয়াছিলেন। যাহা হউক, শেষে সকল গোলই চুকিয়া গেল, আর তখন তো সুখের সীমাই রহিল না।