দধীচি মুনির নাম হয়তো তোমরা অনেকেই শুনিয়াছ। তাঁহার মতন তপস্যা অতি অল্পলোকেই করিয়াছে। মহর্ষি দধীচি অতিশয় শান্ত আর পরম দয়ালু ছিলেন। গঙ্গার ধারে নিজের আশ্রমে থাকিয়া পত্নী প্রাতিথেয়ীকে লইয়া ভগবানের নাম করা, গাছপালার প্রতি যত্ন, সকল জীবে দয়া আর অতিথি আসিলে তাহার সেবা করা, এ সকল ছাড়া তাঁহার আর কাজ ছিল না। কিন্তু এই নিরীহ লোকটির তপস্যার এমনি তেজ ছিল যে, তাহার ভয়ে অসুরেরা তাঁহার আশ্রমের কাছে আসিতেই থরথর করিয়া কাঁপিত। অথচ দেবতাদিগকে সেই অসুরেরা জ্বালাতনের একশেষ করিত। কতকাল ধরিয়া যে ইঁহাদের যুদ্ধ চলিয়াছিল, তাহার ঠিকানাই নাই। সেই যুদ্ধে কখনো দেবতারা জিততেন, কখনো বা অসুরদিগের নিকট হারিয়া বিধিমতে নাকাল হইতেন। যাহা হউক, একবার দেবতারা নানারকমের আশ্চর্য
আশ্চর্য অস্ত্র সংগ্রহ করিয়া অসুরদিগকে খুবই হারাইয়া দিলেন। তারপর তাঁহাদের এই চিন্তা হইল যে, এ সকল অস্ত্রের কাজ তো ফুরাইল, এখন এগুলোকে কোথায় রাখা যায়? যুদ্ধ করিয়া শরীব অত্যন্ত কাহিল হইয়াছে, এগুলোকে আর স্বর্গে বহিয়া নেওয়ার শক্তি নাই, সেখানে লইয়া গেলেও হয়তো আবার কোনদিন অসুরেরা আসিয়া কাড়িয়া নিবে।
শেষে অনেক ভাবিয়া চিস্তিয়া তাঁহারা দধীচির নিকট আসিয়া বলিলেন, “মুনিঠাকুর, আমাদের এই অস্ত্রগুলি যদি দয়া করিয়া আপনার নিকট রাখেন, তবে আমাদের বড় উপকার হয়। আপনার কাছে থাকিলে আর দৈত্যেরা এগুলি চুরি করিতে পারিবে না।” এ কথায় দধীচি সবে বলিয়াছিলেন, “যে আজ্ঞা” অমনি প্রাতিথেয়ী তাঁহাকে বাধা দিয়া বলিলেন, “ওগো, তুমি এই ফ্যাঁসাদের ভিতরে যাইয়ো না। দেবতা মহাশয়েরা এখন মিষ্ট কথা কহিতেছেন, কিন্তু আমাদের এখানে থাকিয়া যদি জিনিসগুলি নষ্ট হয় বা চুরি যায়, তখন ইঁহারা বড়ই চটিবেন।” দধীচি বলিলেন, “তাই তো এখন আর কি করা যায়? “যে আজ্ঞা” বলিয়া ফেলিয়াছি, এখন তো আর ‘না’ বলা যাইতে পারে না।
কাজেই অস্ত্রগুলি দধীচির আশ্রমেই রহিল, আর দেবতারা তাহাতে যারপরনাই তুষ্ট হইয়া নিজের নিজের ঘরে চলিয়া গেলেন। তারপর এক বৎসর যায়, দু বৎসর যায়, ক্রমে সাড়ে তিনলাখ বৎসর কাটিয়া গেল, তবুও দেবতাদের আর কোনো খোঁজ-খবর নাই। ততদিনে অস্ত্রে মরিচা তো ধরিয়াছেই, তাহা ছাড়া অসুরদের আবার বেজায় তেজ বাড়িয়া উঠিয়াছে। দিনরাত কেবল ঐ অস্ত্রগুলির উপর তাহাদের চোখ;না জানি কখন কোন ফাঁকে সেগুলিকে লইয়া যাইবে। তখন দধীচি ভাবিলেন যে, দেবতারা তো আসিলেনই না, এখন অস্ত্রগুলি যাহাতে অসুরদের হাতে না পড়ে, তাহার উপায় দেখিতে হয়।
সে বড় আশ্চর্য উপায়। জলে মন্ত্র পড়িয়া অস্ত্রগুলিকে তাহা দ্বারা ধুইবামাত্র, তাহাদের সকল তেজ সেই জলে গুলিয়া গেল। সে জল দধীচি তখনই খাইয়া ফেলিলেন, কাজেই আর কোন চিন্তার কথাই রহিল না। তারপর দেখিতে দেখিতে অস্ত্রগুলি আপনা হইতেই ক্ষয় হইয়া গেল, তখন অসুরেরা আর কি নিবে?
উপেন্দ্র—৮৬