পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৬৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৯০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 ইন্দ্রগিরির মজার আর একটা গল্প বলিয়া শেষ করিব। একজন অতি বিখ্যাত মুনি ছিলেন, তাঁহার নাম আত্রেয় (অত্রি মুনির পুত্র)। ঠাকুরটি বিস্তর যাগযজ্ঞ করিয়াছিলেন, আর তাহাতে তাঁহার ইচ্ছামতো সংসারের সর্বত্র চলাফেরার ক্ষমতা জন্মিয়াছিল।

 একদিন তিনি বেড়াইতে বেড়াইতে ইন্দ্রের সভায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানকার শোভা দেখিয়া, সেখানকার গীত-বাদ্য শুনিয়া, আর সেখানকার ময়রাদের তৈরি মিষ্টান্ন খাইয়া ঠাকুরের মন এমনই ভুলিয়া গেল যে, তিনি দিনরাতই কেবল ভাবিতে লাগিলেন, ‘আহা! এই তো সুখ, এমনিই তো চাই!’

 তারপর আশ্রমে ফিরিয়া আর তাঁহার নিজের কুঁড়েঘরটি কিছুতেই তাঁহার পছন্দ হয় না। ব্রাহ্মণীকে ডাকিয়া বলিলেন, “ওগো! এসব কি ছাই খাবার আমাকে খাইতে দাও? এসব কি খাইতে ভালো লাগে? ইন্দ্রের বাড়িতে যে চমৎকার মিঠাই খাইয়া আসিয়াছি, ফলমূলের তরকারি কিছুতেই তেমন করিতে পারিবে না!”

 এই বলিয়া তিনি বিশ্বকর্মাকে ডাকিয়া হুকুম দিলেন, “আমার এই আশ্রমটিকে ঠিক ইন্দ্রের পুরীর মতো করিয়া দাও। নইলে তোমাকে শাপ দিয়া ভস্ম করিব! ঠিক তেমনি বাড়ি, তেমনি সভা, তেমনি বাগান, তেমনি হাতি, তেমনি ঘোড়া, তেমনি ঝাড়-লণ্ঠন, তেমনি গান-বাজনা, তেমনি মিঠাই-মণ্ডা, লোকজন—সব অবিকল চাই! খবরদার! যেন কোনো কথার একটু তফাত হয় না!”

 শাপের ভয়ে বিশ্বকর্মা তখনই তাড়াতাড়ি সেখানে এক ইন্দ্রপুরী তয়ের করিয়া দিলেন। মুনি ঠাকুর সেই পুরীতে থাকেন, আর বলেন, “আহা এই তো সুখ! এমনই ত চাই।”

 এমনিভাবে কিছুদিন যায়। ইহার মধ্যে অসুরেরা সেই পুরীর দিকে ভ্রুকুটি করিয়া তাকায় আর বলে, “দেখ ভাই, ইন্দ্র বেটা স্বর্গ ছাড়িয়া চুপিচুপি পৃথিবীতে আসিয়া ঘর বাঁধিয়াছে। চল, এই বেলা উহাকে ধরিয়া বৃত্রকে মারিবার সাজাটা ভালোমতে দিই!”

 অমনি দলে দলে অসুর, “ইন্দ্র বেটাকে মার!” “ইন্দ্র বেটাকে মার!” বলিতে বলিতে আসিয়া সেই পুরী ঘিরিয়া বসিল।

 মুনিঠাকুর মনের সুখে খাটের উপর বসিয়া আছেন, ইহার মধ্যে অসুরদের বিকট চীৎকারে তাঁহার প্রাণ উড়িয়া গেল। দেখিতে দেখিতে লাখে লাখে শেল, শূল, মুষল, মুদ্‌গর, গাছ, পাথর, আসিয়া তাঁহার সাধের পুরী চুরমার করিয়া দিতে লাগিল। দু-একটা তীরের খোঁচা যে না খাইলেন তাহাও নহে।

 তখন তিনি তাড়াতাড়ি কাঁপিতে কাঁপিতে অসুরদের সামনে আসিয়া জোড়হাতে বলিলেন, “দোহাই বাবা, আমি ইন্দ্র নহি! আমি মুনি, ব্রাহ্মণ, অতি নিরীহ দীন হীন মানুষ! আমার উপরে তোমাদের এত ক্রোধ কেন?”

 অসুরেরা বলিল, “ইন্দ্র নহ, তবে ইন্দ্র সাজিয়াছ কেন? শীঘ্র তোমার এসব সাজগোজ দুর করিয়া দাও।”

 মুনি বলিলেন, “এই যে বাপু! এক্ষুণি আমি এসব দুর করিয়া দিতেছি। আমার নিতান্তই মাথা খারাপ হইয়াছিল তাই এমন বেকুবী করিতে গিয়াছিলাম। আর কখনো এমন কাজ করিব না।”

 তখন আবার বিশ্বকর্মার ডাক পড়িল।