কিছুতেই ভালো লাগিত না। নাগপুত্রেরা সমস্ত দিন কুবলয়াশ্বের নিকটে কাটাইয়া রাত্রে গৃহে যাইতে বড়ই কষ্ট বোধ করিতেন, আর কোনোপ্রকারে রাত্রিটি কাটাইয়া প্রভাত হইবামাত্রই পুনরায় কুবলয়াশ্বের নিকট চলিয়া আসিতেন।
একদিন নাগরাজ অশ্বতর তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা, এখন তো আর তোমাদিগকে দিনের বেলায় পাতালে দেখিতে পাইনা, রাত্রিটি কোনোমতে এখানে কাটাইয়া, প্রভাত হইতেই তোমার পৃথিবীতে চলিয়া যাও। ঐ স্থানটার প্রতি তোমাদের এত অনুরাগ কেমন করিয়া হইল?”
নাগপুত্রেরা বলিলেন, “বাবা, আমরা মহারাজ শত্রুজিতের পুত্র ঋতধ্বজকে বড়ই ভালোবাসি; তাঁহাকে না দেখিয়া থাকিতে আমাদের নিতান্ত কষ্ট হয়। তাই প্রভাতে উঠিয়া প্রত্যহ তাঁহার নিকট চলিয়া যাই। বাবা, এমন সুন্দর, এমন সরল, এমন ধার্মিক, এমন মিষ্টভাষী লোক আর এ জগতে নাই!”
এ কথায় নাগরাজ বলিলেন, “বাছা, এমন মহৎ লোকের সহিত তোমাদের বন্ধুত্ব হইয়াছে, আর তাঁহার নিকটে তোমরা এত সুখ পাইতেছ, তোমরা তাঁহার সুখের জন্য কি কিছু করিয়াছ?”
নাগপুত্রেরা বলিলেন, “বাবা, তাঁহার তো কোনো বস্তুরই অভাব নাই এমন মহৎ লোকের যোগ্য কি আছে, যাহা দ্বারা তাঁহাকে সুখী করিতে পারি? তাঁহার কোনো কষ্ট দূর করিতে পারিলে আমরা নিশ্চয় করিতাম। তাঁহার স্ত্রী মদালসার মৃত্যুই তাহার একমাত্র কষ্টের কারণ। সেই মদালসাকে আমরা কোথা হইতে আনিয়া দিব?”
কিন্তু, এ কাজটি যতই কঠিন হউক না কেন, ইহা যে একেবারেই অসাধ্য, নাগরাজ তাহা মনে করিলেন না। তিনি অবিলম্বে হিমালয় পর্বতের প্লক্ষাবতরণ নামক তীর্থে গিয়া কঠোর তপস্যা আরম্ভ করিলেন। সে তপস্যা এমনই চমৎকার হইয়াছিল, আর তখন যে নাগরাজ সরস্বতীর স্তব করিয়াছিলেন, তাহা সরস্বতীর এত ভালো লাগিয়াছিল যে, তিনি আর সেখানে না আসিয়া থাকিতে পারিলেন না!
সরস্বতী আসিয়া বলিলেন, “হে অশ্বতর! আমি তোমাকে বর দান করিব;বল তোমার কি লইতে ইচ্ছা হয়।”
অশ্বতর অমনি করজোড়ে বলিলেন, “মা, যদি কৃপা হইয়া থাকে, তবে আমাকে আর আমার ভাই কম্বলকে সংগীতে অসাধারণ পণ্ডিত করিয়া দিন!”
একথায় সরস্বতী ‘তথাস্তু’ বলিয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলে অশ্বতর আর কম্বল দুভাই তৎক্ষণাৎ সংগীত শক্তি লাভ করত অপরূপ তান লয় সহকারে বীণা বাজাইয়া মহাদেবের স্তবগান আরম্ভ করিলেন। অনেকদিন এইরূপ সংগীত আর স্তবের পর, মহাদেবকেও তুষ্ট হইয়া তাঁহাদিগকে বর দিতে আসিতে হইল। তখন দুই ভাই তাঁহার পদতলে পড়িয়া এই বর প্রার্থনা করিলেন, “কুবলয়াশ্বের স্ত্রী মদালসা যেমন বয়সে, যেমন বেশে, যেমন শরীরে প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন, অবিকল সেই মূর্তিতে, পূর্বজন্মের সকল কথা স্মরণে রাখিয়া, পুনরায় অশ্বতরের গৃহে জন্মলাভ করুন।”
মহাদেব কহিলেন, “তাহাই হউক। অশ্বতর শ্রাদ্ধ করিতে বসিলে তাঁহার মধ্যম ফণা হইতে মদালসা অবিকল তাঁহার পূর্বের শরীর লইয়া বাহির হইবেন।”