পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৭২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭২২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

একটা লোক পথ দিয়া যাইতেছে, আর প্রাণপণে নিজের চেহারাটাকে ভয়ংকর করিবার চেষ্টা করিতেছে। এসব দেখিয়া তাহাদের বড়ই হাসি পাওয়ায় তাহাদের একজন আসিয়া রাবণের হাত ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে বাপু? তোমার বাবার নাম কি? এখানে আসিয়াছ কি করিতে?” এ কথায় রাবণের একটু রাগ হইল। সে খুব গম্ভীর সুরে উত্তর দিল, “আমি বিশ্রবার পুত্র রাবণ। এখানে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছি, কাহাকেও দেখিতে পাইতেছি না।”

 শুনিয়া মেয়েরা সকলে খিল খিল করিয়া হাসিতে লাগিল। তারপর তাহাদের একজন এক হাতে রাবণের কোমর ধরিয়া অন্য মেয়েদের সামনে নিয়া তাহাকে ঘুরাইতে ঘুরাইতে বলিল, “দেখ দেখ, আমি কেমন একটা কালো পোকা ধরিয়াছি; এর আবার দশটা মাথা, কুড়িটা হাত!” বলিয়াই সে সেটা আর একজনকে ছুঁড়িয়া দিল, সে আবার দিল আরেকজনের হাতে ছুঁড়িয়া। তখন তো রাবণকে লইয়া খুবই একটা লোফালুফির ধুম পড়িয়া গেল। মেয়েদের তাহাতে আমোদের সীমাই নাই, কিন্তু রাবণ বেচারার প্রাণ লইয়া টানাটানি। কাজেই তখন সে আর কি করে? সে দশ মুখের তিনশত বিশ দাঁতে ‘কট্টাশ!’ করিয়া এক মেয়ের হাতে এক কামড় বসাইয়া দিল। সে মেয়ে তো তখনই “মা-া-া-া গো-া-া!” বলিয়া তাহাকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া প্রাণপণে হাত ঝাড়িতে লাগিল। ততক্ষণে আরেকটি মেয়ে তাহাকে ধরিয়া শূন্যে লইয়া গিয়াছিল, তাহার হাতে সে দিল ভয়ানক আঁচড়াইয়া! সে মেয়েটি তখন তাড়াতাড়ি তাহাকে ছুঁড়িয়া একেবারে সমুদ্রের মাঝখানে ফেলিয়া দিল।

 নারদমুনি অবশ্য এতক্ষণ সেইখানে দাঁড়াইয়া তামাশা দেখিতেছিলেন, আর আনন্দে অস্থির হইয়া কেবলই হো হো শব্দে হাস্য আর করতালি দিয়া নৃত্য করিতেছিলেন।

 বলাবাহুল্য, রাবণের যুদ্ধের সাধ সেদিন সেই সমুদ্রের জল খাইয়া মিটিয়াছিল।


শব্দবেধী

 জন্তুকে না দেখিয়া, কেবলমাত্র তাহার শব্দ শুনিয়াই যে তাহাকে তীর দিয়া বিঁধিতে পারে, তাহাকে বলে ‘শব্দবেধী’।

 রাজা দশরথ এইরূপ ‘শব্দবেধী’ ছিলেন। যুবা বয়সে অনেক সময় তিনি রাত্রিতে বনে গিয়া এইরূপে কত হাতি, মহিষ, হরিণ শিকার করিতেন। বর্ষার রাত্রে তীর-ধনুক লইয়া চুপিচুপি সরযুর ধারে বসিয়া থাকিতে তাঁহার বড়ই ভালো লাগিত। নদীর ঘাটে নানারূপ জন্তু জল খাইতে আসিত; সেই জলপানের শব্দ একটিবার দশরথের কানে গেলে আর সে জন্তুকে ঘরে ফিরিতে হইত না।

 একবার এইরূপ বর্ষার রাত্রিতে দশরথ সরযুর ধারে তীর-ধনুক লইয়া বসিয়া আছেন। মনে আর কোনো চিন্তা নাই, খালি কান পাতিয়া রহিয়াছেন, কখন কোন জানোয়ারের শব্দ শোনা যাইবে। প্রায় সমস্ত রাত্রি এইভাবে কাটিয়া গিয়াছে, ভোর হইতে আর বেশি বাকি নাই। এমন সময় নদীর ঘাট হইতে ‘গুড়্‌-গুড়্‌-গুড়্‌-গুড়্‌’ করিয়া একটা আওয়াজ আসিল!

 দশরথ চমকিয়া ভাবিলেন, ‘ঐ হাতি।’ আর সেই মুহূর্তেই সেই শব্দের দিকে একটি