অবশ্য, শিক্ষকের ভরসা কেবলমাত্র তাহার অকুতোভয়তা এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছাড়া আর কিছুরই উপরে নহে। তাহা ছাড়া আর কিছু যদি থাকে, তবে তাহা একটি স্বাভাবিক শক্তি, যাহার প্রভাবে কেবলমাত্র তাহার একটি ভ্রুকুটিতেই হিংস্র জন্তুর মনে আতংকের সঞ্চার করিয়া দিতে পারে।
যেমন করিয়াই হউক, জন্তুগুলির মনে এমন একটা বিশ্বাস থাকা চাই যে, ‘ইহাকে আমরা কিছুতেই আঁটিতে পারিব না। এ ব্যক্তি যাহা বলে, তাহাই আমাদের করিতে হইবে।’ কোনো কারণে এ ভয় একবার ভাঙ্গিয়া গেলে আর সে ব্যক্তির সে জন্তুর উপরে কোনো প্রভুত্ব থাকে না। শিক্ষক যদি কখনো মাতাল হইয়া জন্তুর খাঁচায় ঢোকে, জন্তুগুলি অমনি তাহার দুরবস্থা বুঝিতে পারে। তখন যদি ঈশ্বরের বিশেষ কৃপায় সে প্রাণ লইয়া খাঁচার ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিতে পারে, তাহা হইলেই তাহার সৌভাগ্য বলিতে হয়।
প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কথা বলিতেছিলাম, তাহার একটি দৃষ্টান্ত দিই। একজন শিক্ষক কোনো কারণে ভয়ানক রাগিয়া গিয়া একটি বাঘকে চাবুকের সীসে বাঁধান গোড়াটা দিয়া কয়েকটা কঠিন আঘাত করিয়াছিল। ইহাতে মুহূর্তের জন্য বাঘটা একটু কাহিল হইল বটে, কিন্তু তাহার পরক্ষণেই হাঁ করিয়া শিক্ষককে আক্রমণ করিল। শিক্ষক তখন আর কি করে, তাড়াতাড়ি তাহার চাবুকের গোড়াটা সেই হাঁ-র ভিতর দিয়া একেবারে বাঘের গলার ভিতরে ঢুকাইয়া দিল। ইহাতে বাঘটা ক্ষণেকের জন্য ভারি অপ্রতিভ হইয়া গেল। ততক্ষণে শিক্ষকের চিৎকার শুনিয়া দুইজন লোক ছুটিয়া আসিল। সৌভাগ্যক্রমে সেখানে আগুন ছিল, আর তাহাতে একটা লোহা তাতিয়া একেবারে লাল হইয়াছিল। একজন লোক তাড়াতাড়ি সেই জ্বলন্ত লোহাটা লইয়া খাঁচার ভিতরে ঢুকিয়া বাঘটাকে সেই লোহা দিয়া খোঁচা মারিল। তাহার পর বাঘটা যেই ভয়ানক গর্জন করিয়া তাহার দিকে ফিরিয়াছে, অমনি একেবারে, তাহার মুখে লাল লোহার “ছ্যাঁকা” লাগাইয়া দিল। বাঘ পৃষ্ঠভঙ্গ দিয়া খাঁচার কোণে গিয়া লুকাইল, আর অমনি শিক্ষক আর তাহার লোক খাঁচার বাহিরে আসিয়া দরজা আটকাইয়া দিল।
অনেক সময় বিনা কারণে অথবা অতি সামান্য কারণেও এক-একটা জানোয়ার হঠাৎ ক্ষেপিয়া যায়। বাস্তবিক, যাহারা ইহাদের খাঁচার ভিতরে যায় তাহাদিগকে প্রতি মুহুর্তেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকিতে হয়। নিতান্ত ভালো জানোয়ারটাও কখন হঠাৎ ক্ষেপিয়া আক্রমণ করিবে, তাহার ঠিক নাই। আবার একটা যদি আক্রমণ করে, তাহা হইলে অন্যগুলিও খুব সম্ভবত তাহার পক্ষ হইয়া তাহাতে যোগ দিবে।
যাহারা সর্বদা এ কাজ করে, তাহাদের এত বিপদ। কিন্তু এমন পাগলও পৃথিবীতে আছে, যে কখনো এ কাজ করে নাই, অথচ খাঁচার ভিতরে গিয়া বাহাদুরি উপার্জন করিবার জন্য ব্যস্ত। একবার একজন ধর্মযাজক এইরূপে প্রাণ হারাইয়াছিল। বেচারা স্বভাবতই একটু উকন্দ্র, ইহার মধ্যে আবার একদিন তাহার কেমন খেয়াল চাপিল, সে মনে করিল যে, বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়া বক্তৃতা করিতে পারিলে অনেক লোক শুনিতে আসিবে, আর তাহাতে খুব জমাট প্রচার হইবে। সুতরাং সে নিকটবর্তী এক সার্কাস ওয়ালার সঙ্গে বন্দোবস্ত করিল যে, অমুক দিন তাহার বাঘের খাঁচার ভিতর হইতে সে বক্তৃতা করিবে। সার্কাসওয়ালা প্রথমে রাজি হয় নাই। সে বলিল, “তুমি ভয় পাইবে।
ধর্মযাজক বলিল, “আমার কিছুতেই ভয় নাই।”