খানিক পরে দেখি, একটা ছোট মাছরাঙ্গা গর্তের ভিতর হইতে মাথা বাহির করিয়াছে। বাহিরের জগতের সহিত তাহার এই প্রথম পরিচয়। তাহার চারিদিক দেখা শেষ হইতে না হইতেই কে যেন পিছন হইতে তাহাকে এক ঠেলা দিল। সেও অমনি আর কিছু না বলিয়া উড়িয়া নদীর অন্যপারে একটা মরা গাছের ডালে গিয়া বসিল। তাহার পর আর একটি তাহার পর আরো একটি ঠিক ঐরকম করিয়া বাহির হইল, যেন প্রত্যেককে কি করিতে হইবে, কোথায় যাইতে হইবে, তাহা আগে হইতেই বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। ক্রমে ক্রমে সবগুলি ছানা সার দিয়া বসিল, তাহাদের নীচে পরিষ্কার জল, উপরে নীল আকাশ, আর চারিদিকে গাছপালা।
এই তাহাদের হাতেখড়ি এবং ইহার জন্য পুরস্কারের অভাব ছিল না। তাহাদের বাবা ভোর হইতে ছোট মাছ ধরিয়া এক জায়গায় জড়ো করিয়াছে। সেই মাছ এখন তাহাদিগকে খাইতে দিয়া সে তাহার নিজের ভাষায় তাহাদিগকে বুঝাইতে চেষ্টা করিল যে, এতদিন তাহারা যে অন্ধকার গর্তে ছিল, এই পৃথিবী সেরকম নয়। এখানে ভালো-ভালো খাবার জিনিস অনেক পাওয়া যায় সুখও খুব আছে।
ছোট-ছোট মাছরাঙ্গাগুলির এখন মাছ ধরিতে শিক্ষা চাই। একটা নিরিবিলি জায়গায় তাহাদের স্কুল বসিল। এখানে খুব কম জল আর জলের নীচে কাদার উপরে মাছ স্পষ্ট দেখা যায়। জলের উপর একটা গাছের ডাল ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে, বড় মাছরাঙ্গা দুইটা অনেকগুলি ছোট-ছোট মাছ মারিয়া ঐ ডালের নীচে জলে ছড়াইয়া রাখিল। তাহার পর ছানাগুলিকে আনিয়া ডালের উপর বসাইয়া, নিজেরা এক-একবার ডুব দিয়া দেখাইয়া দেয়, আর তাহাদিগকেও সঙ্গে সঙ্গে ডুব দিতে বলে। ছোট মাছরাঙ্গাদের ক্ষুধা পাইয়াছিল কাজেই মরা মাছগুলি ধরিতে তাহাদের উৎসাহের কোনরূপ ক্রটি হইল না। যাহারা একটু ভীতু, প্রথমে। জলে নামিতে ভরসা পায় নাই, লোভে পড়িয়া শেষে তাহাদেরও সাহস হইল।
ইহার কিছুদিন পরে একদিন নদীর ধারে বেড়াইতে বেড়াইতে আমি একটা ছোট জলা জায়গা দেখিতে পাইলাম। ঐ জলের সঙ্গে নদীর কোনে যোগ নাই। জলের মধ্যে কতকগুলি মাছ যেন হঠাৎ কোনো অচেনা জায়গায় আসিয়া পড়িয়াছে, এইভাবে ছুটাছুটি করিতেছে। আমি ভাবিতে লাগিলাম, মাছগুলি কি করিয়া নদী ও ঐ জলের মাঝখানের জায়গাটুকু পার হইল। এমন সময়ে দেখি যে, একটি মাছরাঙ্গা মাছ মুখে করিয়া উড়িয়া আসিতে আসিতে আমাকে দেখিয়াই ঘুরিয়া অন্য দিকে চলিয়া গেল। তখন মনে করিলাম, বুঝি ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য আরো কোন অদ্ভুত উপায় বাহির হইয়াছে। এই ভাবিয়া ঝোপের আড়ালে লুকাইলাম। ঘণ্টাখানেক পরে মাছরাঙ্গাটি চুপিচুপি আসিয়া একবার সাবধানে সকল দিক দেখিয়া, আবার ডাকিতে ডাকিতে চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরেই সে তাহার সমস্ত পরিবার লইয়া সেই জলার ধারে উপস্থিত। মাছ ধরা আরম্ভ হইল। ছানাগুলি তাহাদের মা-বাপকে ডুব দিতে দেখিয়া আর তাহাদের ধরা মাছের আস্বাদন পাইয়া নিজেরাও ডুব দিতে লাগিল। প্রথমবার কিছুই ধরিতে পারিল না। তাহাদিগকে উৎসাহ দিবার জন্য বড় মাছরাঙ্গারা কয়েকটা আহত মাছও অন্যান্য মাছের সঙ্গে জলে ফেলিয়া দিয়াছিল, তাহারা বেশি ছুটিতে পারে না, কাজেই তাহাদিগকে ধরা সহজ। ছোট মাছরাঙ্গারা প্রথমে সেইসব মাছ ধরিল। দু-একটা ধরিয়াই তাহারা যেন মাছ ধরিবার সন্ধান বুঝিয়া ফেলিল। তাহার পর ঠোট নীচের দিকে