ছেলে চারিটি যেমন সুন্দর, তেমনি বুদ্ধিমান, আর তেমনি তাঁহাদের মিষ্ট স্বভাব। ভাল ছেলের যতরকম গুণ থাকিতে হয় তাহার কিছুই তাঁহাদের কম ছিল না। অল্পদিনের ভিতরেই তাহারা যার-পর নাই বিদ্বান আর বীর হইয়া উঠিলেন। লেখায়, পড়ায়, যুদ্ধে, শিকারে কোন কাজেই তাঁহাদের মতন আর কেহ ছিল না।
ভাইকে কেমন করিয়া ভালবাসিতে হয়, তাহা রাম, লক্ষ্মণ, ভরত আর শত্রুঘকে দেখিলে বুঝিতে পারিতে। তাহার মধ্যে আবার রামকে লক্ষ্মণ আর ভরতকে শত্রুঘ্ন আরও বেশি করিয়া ভালবাসিতেন। ইহাদিগকে দেখিলে সকলেই সুখী হইত। রাজা দশরথ যে কতখানি আনন্দিত হইতেন, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না।
একদিন রাজা দশরথ পুরোহিত আর মন্ত্রীদিগকে লইয়া ছেলেদের বিবাহের পরামর্শ করিতেছে, এমন সময় বিশ্বামিত্র মুনি তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। মুনিদের ভিতরে বিশ্বামিত্রের মান বড়ই বেশি। তাঁহার মত তপস্যা খুব কম লোকেই করিয়াছে; তেমন ক্ষমতাও খুব কম লোকেরই আছে। তাহাতে আবার লোকটি বিলক্ষণ একটু রাগী। এরূপ লোককে যেমন করিয়া আদর যত্ন করিতে হয়, দশরথ তাহার কিছুই বাকি রাখিলেন না। তারপর তিনি বলিলেন, 'মুনিঠাকুর, আপনি যে আসিয়াছেন, ইহা আমার বড়ই সৌভাগ্য; আর ইহাতে আমি খুবই সুখী হইলাম। এখন আপনি কী চাহেন বলুন, আমি তাহাই দিতেছি।'
দশরথ ভাবিয়াছিলেন, মুনি টাকা-কড়ি চাহিবেন। কিন্তু মুনি যাহা চাহিলেন, তাহাতে তাঁহার প্রাণ শুকাইয়া গেল। বিশ্বামিত্র বলিলেন, 'মহারাজ, আমি যেজন্য আসিয়াছি তাহা শুন। আমি একটা যজ্ঞ করিয়াছিলাম, ইহার মধ্যে মারীচ আর সুবাহু নামে দুই রাক্ষস আসিয়া তাহাতে মাংস ঢালিয়া সব নষ্ট করিয়া দিয়াছে। শুনিয়াছি রাবণ নামে একটা ভয়ানক দুষ্ট রাক্ষস আছে, ইরা তাহারই লোক। তুমি যদি দশ দিনের জন্য তোমার রামকে আমার সঙ্গে দাও, তবে সে রাক্ষসদুটাকে মারিয়া দিতে পারে। রাম ছাড়া আর কেহই এ কাজ করিতে পারিবে না। রাম এখন বড় হইয়াছে আর বীরও যেমন-তেমন হয় নাই। রাক্ষসের সাধ্য কী যে তাহার সঙ্গে যুদ্ধ করে। তোমার কোন ভয় নাই। রামকে দিয়া আমার এ কাজটি করাইয়া দাও, ইহাতে ভাল হইবে।
মুনির কথা শুনিয়াই তো দশরথ কাঁপিতে কাঁপিতে অজ্ঞান হইয়া গেলেন। খানিক পরে একটু সুস্থ হইয়া তিনি বলিলেন, 'মুনিঠাকুর আপনার পায়ে পড়ি, আমি রামকে দিতে পারিব না। আমার রাম কি এ-সকল ভয়ানক রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে পারিবে? না-হয় আমি নিজেই অনেক লোকজন লইয়া আপনার যজ্ঞে পাহারা দিব। রামকে ছাড়িয়া দিন।' ইহাতে বিশ্বামিত্র এমনই রাগিয়া গেলেন যে, তাঁহার রাগ দেখিয়া দেবতারা পর্যন্ত অস্থির।
যে সর্বনেশে মুনি, ইঁহার আরও বেশি রাগ হইলে কি আর রক্ষা ছিল। কাজেই তখন বশিষ্ঠ মুনি রাজাকে অনেক বুঝাইয়া বলিলেন, 'মহারাজ, শীঘ্র রামকে আনিয়া দিন, ইহাতে রামের ভাল হইবে। বিশ্বমিত্র যেমন তেমন মুনি নহেন, ইঁহার সঙ্গে যাইতে রামের কোনও ভয় নাই। তাহার ভালর জন্যই বিশ্বামিত্র তাহাকে লইতে আসিয়াছেন।’ বশিষ্ঠের কথা শুনিয়া দশরথের আর ভয় রহিল না। তিনি তখনই রাম আর লক্ষ্মণকে আনিয়া দিলেন।
যুদ্ধের পোশাক পরিয়া, তীর ধনুক খড়্গ লইয়া, বিশ্বামিত্রের পিছু-পিছু দুই ভাইকে যাইতে বড়ই সুন্দর দেখাইতেছিল। রাজা আর রাণীরা তাঁহাদের মাথায় চুমা খাইয়া তাঁহাদিগকে