এইরূপে পাঁচ দিন চলিয়া গেল। ছয় দিনের দিন তাঁহারা আরও বেশি করিয়া পাহারা দিতে লাগিলেন। এমন সময় দপ্ করিয়া যজ্ঞের বেদী জ্বলিয়া উঠিল। তাহার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে ভয়ানক শব্দ, আর যজ্ঞের জায়গায় রক্ত-বৃষ্টি। তখন রাম উপরের দিকে চাহিয়া দেখিলেন যে, মারীচ আর সুবাহুর সঙ্গে বড় বড় বিকটাকার রাক্ষসেরা দল বাঁধিয়া যজ্ঞ নষ্ট করিতে আসিয়াছে।
তাহা দেখিয়া রাম মারীচের বুকে মানবাস্ত্র নামক বাণ ছুঁড়িয়া মারিলেন। বাণের চোটে সে বেচারা অজ্ঞান হইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে একেবারে একশত যোজন দূরে সমুদ্রে গিয়া পড়িল। তারপর রাম আগ্নেয়াস্ত্র ছুঁড়িলে তাহার ঘা খাইয়া সুবাহু সেইখানেই পড়িয়া মরিল। বাকি রাক্ষসগুলিকে মারিতে খালি বায়ব্য অস্ত্র ছাড়া আর কিছুর দরকার লাগে নাই। তখন মুনিগণের যে কি আনন্দ হইল, তাহা কি বলিব!
অনেক পরিশ্রমের পর সে রাত্রিতে লতা-পাতার বিছানায় রাম লক্ষ্মণ বড়ই সুখে ঘুমাইলেন। পরদিন সকালে মুনিরা বলিলেন, চল বাবা, মিথিলায় যাই। সেখানকার রাজা জনক যজ্ঞ করিকেন, তাহা দেখিতে হইবে। আর সেখানে একখানা ভয়ঙ্কর ধনুক আছে, তাহাতে এত জোর যে, দেবতা, গন্ধর্ব, রাক্ষস, মানুষ কেহই তাহাতে গুণ দিতে পারে নাই; সেই ধনুকখানাও দেখিতে হইবে। এই বলিয়া মুনিরা মিথিলায় যাইবার জন্য জিনিসপত্র বাঁধিয়া লইলেন। জিনিস নিতান্ত কম ছিল না, একশতখানা গাড়ি তাহাতেই বোঝাই হইয়া গেল।
সবুজ শস্যের ক্ষেতের মধ্য দিয়া তাঁহাদের চলিবার পথ। সে পথে যাইতে রাম লক্ষ্মণের বড়ই ভাল লাগিতেছিল। সেদিনকার রাত্রিতে তাঁহারা শোণ নদের ধারে আসিয়া রহিলেন। তাহার পরের রাত্রি গঙ্গার ধারে, তাহার পরের রাত্রি বিশালা নগরে কাটিল। চারি দিনের দিন সকালবেলায় তাঁহারা দূর হইতে মিথিলার সুন্দর রাজপুরী দেখিতে পাইলেন। ঐ স্থানের নিকটেই একটি অতি সুন্দর আর খুব পুরাতন আশ্রম ছিল। তাহা দেখিয়া রাম বিশ্বামিত্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, গুরুদেব, এটি কাহার তপোবন? এখানে বেন লোকজন নাই?
বিশ্বামিত্র বলিলেন, 'বাছা, এটি গৌতম মুনির আশ্রম। গৌতমের স্ত্রী অহল্যা একবার একটা নিতান্ত অপরাধের কাজ করাতে গৌতম তাঁহাকে এই বলিয়া শাপ দিয়াছিলেন, “তুই এইখানে ছাইয়ের উপর পড়িয়া থাক্। তোকে কেহ দেখিতে পাইবে না। বাতাস ভিন্ন তুই আর কিছু খাইতে পাইবি না। এইরূপে তোর অনেক বৎসর কাটিবে। তারপর যখন দশরথের পুত্র রাম এইখানে আসিবেন, তখন তাঁহার পূজা করিস। তাহা হইলে আবার তুই ভাল হইবি, আর আমিও ফিরিয়া আসিব।” এই বলিয়া গৌতম কৈলাস পর্বতে চলিয়া গেলেন। রাম, তুমি একবার এই আশ্রমের ভিতরে আইস। তাহা হইলে অহল্যা আবার ভাল হইতে পারেন।'
গৌতমের আশ্রমে গিয়া তাঁহারা অহল্যা দেবীকে দেখিতে পাইলেন। এত দিন ধরিয়া তিনি কেবলই তপস্যা করিয়াছেন। তাহাতে তাঁহার শরীরের এমন আশ্চর্য তেজ হইয়াছে যে দেবতারাও তাঁহার দিকে তাকাইতে পারেন না। এতদিন গৌতমের শাপে কেহই তাঁহাকে দেখিতে পায় নাই। এখন রাম আসিয়াছেন বলিয়া সকলেই তাঁহাকে দেখিল। অহল্যাকে দেখিয়া রাম লক্ষ্মণ তাঁহার পায়ের ধূলা মাথায় করিয়া লইলেন। অহল্যাও গৌতমের কথা মনে করিয়া রামকে পূজা করিলেন। এদিকে গৌতম মুনি হিমালয়ে থাকিয়া তপস্যার দ্বারা সকল কথাই জানিতে পারিয়াছেন। সুতরাং তিনিও তখন সেই আশ্রমে আসিয়া উপস্থিত। এইরূপে অহল্যার