দুঃখের শেষ হইল। তারপর গৌতম আর অহল্যা দুজনে মিলিয়া মনের সুখে ঈশ্বরের আরাধনা করিতে লাগিলেন।
গৌতমের আশ্রম হইতে মিথিলা বেশি দূরে নয়। সেখানে গিয়া সকলে দেখিলেন যে, জনক রাজা অতি চমৎকার যজ্ঞের আয়োজন করিয়াছেন। কত মুনি, কত লোকজন, কত গাড়ি ঘোড়া সেখানে আসিয়াছে, তাহা গণিয়া উঠা ভার। বিশ্বামিত্র তাঁহাদের থাকিবার জন্য সেই ভিড়ের এক কোণে একটি নিরিবিলি জায়গা খুঁজিয়া লইলেন। ততক্ষণে রাজা জনকও খবর পাইয়া বিশ্বামিত্রকে আদর করিবার জন্য সেখানে আসিয়াছেন; সঙ্গে তাঁহার পুরোহিত শতানন্দ মুনি।
বিশ্বামিত্রকে নানারূপ সম্মানে তুষ্ট করিয়া রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, 'মুনিঠাকুর, আপনার সঙ্গের এই ছেলেদুটি কী সুন্দর’ আহা, যেন দুটি দেবতার ছেলে! এ দুটি কোন্ রাজার পুত্র? আর কি জন্য এত কষ্ট করিয়া এখানে আসিয়াছেন?’ বিশ্বামিত্র বলিলেন, 'মহারাজ, ইঁহারা অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র। সিদ্ধাশ্রমে রাক্ষসদিগকে মারিয়া, তারপর গৌতমের আশ্রমে অহল্যার কষ্ট দূর করিয়া এখানে আসিয়াছেন। এখন ইঁহাদের সেই শিবের ধনুক দেখিবার ইচ্ছা।'
জনকের পুরোহিত শতানন্দ মুনি গৌতমের বড় ছেলে। তিনি যখন শুনিলেন যে তাঁহার মাতা আবার ভাল হইয়াছে, তখন তাঁহার মনে কী সুখই হইল! তিনি রামকে কতই স্নেহ দেখাইলেন আর বিশ্বামিত্রের কত প্রশংসা করিলেন, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, বিশ্বামিত্রই রামকে আনিয়া তাঁহার মায়ের দুঃখ দূর করিয়াছেন।
পরদিন সকালবেলায় বিশ্বামিত্র জনককে বলিলেন, äমহারাজ, সেই ধনুকখানি রাম লক্ষ্মণ একবার দেখিতে চাহেন'।
জনক বলিলেন, ‘ধনুকের কথা বলি শুনুন। এই ধনুক আগে ছিল শিবেব। শিব একবার দেবতাদের উপর চটিয়া গিয়া এই ধনুক হাতে তাঁহাদিগকে তাড়া করিয়াছিলেন, কিন্তু দেবতারা অনেক মিনতি করাতে খুশি হইয়া ধনুকখানা তাঁহাদিগকেই দিলেন। দেবতারা আবার রাজা দেবরাতের নিকট তাহা রাখেন। এই দেবরাত আমার পূর্বপুরুষ।
'ইহার পর একদিন আমি লাঙ্গল দিয়া যজ্ঞের স্থান চষিতেছিলাম। এমন সময় আমার লাঙলের মুখের কাছে পৃথিবী হইতে একটি পরমা সুন্দরী কন্যা উঠিল। সেই মেয়েটি এতদিন আমার ঘরে থাকিয়া এখন বড় হইয়াছে। লাঙলের মুখে উঠিয়াছিল বলিয়া আমি তাহার নাম রাখিয়াছি সীতা। আমার প্রতিজ্ঞা এই যে, এই শিবের ধনুকে যে গুণ দিতে পারিবে তাহাকেই এই মেয়ে দিব।
'তারপর কত রাজা আসিয়াছে, কিন্তু তাহারা ধনুকে গুণ দিবে কি, তাহা তুলিতেই পারে। তখন তাহারা ভয়ানক চটিয়া গিয়া আমার সহিত যুদ্ধ করিতে আসিল। আমি অনেক কষ্টে, দেবতাদের সাহায্য লইয়া শেষে শত্রুদিগকে তাড়াই। এখন সেই ধনুক আমি রাম লক্ষ্মণকে দেখাইব। রাম যদি তাহাতে গুণ দিতে পারেন, তবে তিনি সীতাকে পাইবেন।'
তখন জনকের হুকুমে ধনুকখানা বাড়ির ভিতর হইতে বাহিরে আনা হইল। আট চাকার গাড়ির উপরে, লোহার সিন্ধুকের মধ্যে ধনুকখানি রহিয়াছে। তাহা টানিয়া আনিতে পাঁচ হাজার জোয়ান কাহিল! রাম সেই ধনুক দেখিয়া কহিলেন, “এটাতে গুণ দিতে হইবে নাকি?' বিশ্বামিত্র আর জনক বলিলেন, 'হ্যাঁ'।