পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিবিধ প্রবন্ধ
৯০৯
রামজীবন

 রামজীবন বলিলাম বটে, কিন্তু তার নাম রামজীবন ছিল, কি আর কিছু ছিল তাহা জানি না |

 সে অনেকদিনের কথা; এদেশে তখন ইংরাজের রাজত্ব ভাল করিয়া হয় নাই। বাঙ্গালা দেশের অধিকাংশ তখন হিন্দু রাজার অধীন ছিল। রামজীবন ঐ সময়ে পূর্ব বাঙ্গালার একটি ক্ষুদ্র বিভাগের শাসনকর্তা ছিলেন। রামজীবনের বংশ, এবং তাহার সেই সুন্দর বাড়ীর ভগ্নাবশেষ এখনও বর্তমান।

 রামজীবন যারপরনাই ধার্মিক লোক ছিলেন; এবং প্রজাদিগকে অতিশয় স্নেহের সহিত পালন করিতেন। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং সাধু সজ্জনের প্রতি তাহার সদব্যবহারের সুখ্যাতি সমস্ত বাঙ্গালায় ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। নবদ্বীপ হইতে বড় বড় পণ্ডিতগণ রামজীবনের সুখ্যাতি শুনাইয়া তাহার সভায় আসিতেন, এবং সেখানে আশাতিরিক্ত অভ্যর্থনা প্রাপ্ত হইয়া আনন্দে আশীর্বাদ করিতে করিতে দেশে ফিরিতেন।

 ইহার মধ্যে একবার বাঙ্গালার ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হইল। পূর্ব বাঙ্গালার সেই সকল স্থান অতিশয় উর্বরা বলিয়া প্রসিদ্ধ। অন্য স্থানে যখন ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়, তখনও সেখানকার লোকেরা না খাইয়া মরে না। কিন্তু যে বারের কথা বলিতেছি, তখনকার মতন দুর্ভিক্ষ বুঝি আর কখনও হয় নাই। অতিশয় বৃদ্ধ লোকদের মুখে শুনিয়াছি—তাঁহারাও আবার তাঁহাদের ছেলেবেলার বৃদ্ধদের নিকট শুনিয়াছিলেন—যে সেই সময়ে ভদ্রলোকেরাও বনের কচু সিদ্ধ করিয়া খাইয়া জীবনধারণ করিয়াছিলেন। শেষটা কচু ফুরাইয়া গেলে নাকি কলাগাছের থোড়, মোচা, এমনকি, শিকড় পর্যন্ত খাইতে হইয়াছিল।

 এই দারুণ দুর্ভিক্ষে প্রজার ক্লেশ দেখিয়া রামজীবন নিতান্তই ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। যাহারা নিতান্ত গরীব, তাহদের খাজনা মাপ করিয়া দিলেন। যাহাঁদের তাহাতেও কুলাইল না, তাহাদিগকে নিজের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইতে লাগিলেন। রাজসরকার হইতে যে বেতন পাইতেন, তাহ নিতান্তই অল্প ছিল না;কিন্তু দেশ সুদ্ধ লোককে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইতে তাহাতে কুলায় না। বেতনের টাকা ফুরাইয়া গেলে, ঘরের সঞ্চিত টাকা বাহির করিয়া দিলেন। এইরূপ করিয়া যখন নিজের অবস্থাও অন্যের অবস্থার ন্যায় হইয়া দাঁড়াইল, তখন “যা করেন ভগবান” বলিয়া রাজকোষ প্রজার জন্য মুক্ত করিয়া দিলেন। এতটার পর বুঝি দুর্ভিক্ষের মনেও লজ্জা বোধ হইল! —তাহার কঠোরতা ক্রমেই কমিয়া আসিতে লাগিল। দেশের মধ্যে স্বচ্ছলতা আবার ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া রামজীবন সকল চেষ্টা সফল জ্ঞান করিলেন।

 যে স্থানের কথা বলিতেছি, সে স্থান তখন ফাগ এবং তঞ্জের বস্ত্রের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এবং বার্ষিক রাজকর টাকায় না লইয়া, এই দুই জিনিসের দ্বারা আদায় করাই নিয়ম ছিল। দুর্ভিক্ষের সময় লৈাকে খাইতে পায় নাই সুতরাং তাহারা উদরের চিস্তাতেই দিন কাটাইয়াছে। সূক্ষ্ম বস্ত্র বুনিবার অথবা সুন্দর রঙ প্রস্তুত করিবার অবসর তাহদের হয় নাই। তাহা ছাড়া রামজীবন নিজে নিঃস্ব হইয়া পড়িয়াছেন, আর রাজকোষের অর্থ দ্বারা প্রজার প্রাণ রক্ষা