পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের রামায়ণ
৯১

 এত বড় ধনুক তুলিতে রামের একটু কষ্ট হইলেও তাঁহার নিন্দার কথা ছিল না। কিন্তু কষ্ট হওয়া দুরে থাকুক, বরং সে কাজটা তাঁহার খুব সহজই বোধ হইল। যেই ধনুক তোলা, অমনি তাহাতে গুণ চড়ানো। তারপর গুণ ধরিয়া এক টান দিতেই, ধনুক ভাঙিয়া একেবারে দুইখান! এমনি সহজে রাম সেই ধনুক ভাঙিলেন।

 কিন্তু রাম তাহা সহজে ভাঙিলেন বলিয়া তো ধনুকখানি সহজ ধনুক ছিল না! আর সে ধনুক ভাঙার ব্যাপারখানাও যেমন তেমন ব্যাপার হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না; কারণ, তাহার শব্দে বিশ্বামিত্র, জনক আর রাম লক্ষ্মণ ছাড়া সকল লোক চিৎপাত হইয়া পড়িয়া অজ্ঞান হইয়া গিয়াছিল। তখন জনক বলিলেন, 'রামের গায়ে আশ্চর্য জোর! এমন আর কাহারও নাই। আমি ইহার সঙ্গেই সীতার বিবাহ দিব।'

 তখনই পত্র লইয়া দূতেরা দশরথকে আনিতে অযোধ্যায় চলিল। দশরথও তাহাদের মুখে সকল কথা শুনিয়া আর বিলম্ব করিলেন না। পরদিনই বশিষ্ঠ আর অন্য-অন্য পুরোহিত ব্রাহ্মণ প্রভৃতিকে সঙ্গে লইয়া তিনি মিথিলা যাত্রা করিলেন। ধন-রত্ন, গাড়ি-ঘোড়া, সৈন্য-সামন্ত, কত সঙ্গে লইলেন তাহার লেখাজোখা নাই। মিথিলায় পৌঁছিতে তাঁহাদের চারি দিন লাগিল।

 রাজায় রাজায় দেখা হইলে একটা খুবই ধূমধাম হইয়া থাকে। সে আর কত বর্ণনা করিব? কিন্তু আসল কাজের কথাটা, রামের বিবাহের কথা। সে-বিষয়ের পরামর্শ কিরূপ হইয়াছিল, বলিতেছি।

 জনক রাজার আর একটি মেয়ে ছিল, তাহার নাম ঊর্মিলা। তাহা ছাড়া, জনকের ভাই রাজা কুশধ্বজের দুটি মেয়ে ছিল, তাহাদের নাম মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তি। রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘু এই চারিটি ভাইয়ের সঙ্গে সীতা, ঊর্মিলা, মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তি এই চারিটি বোনের বিবাহ হইলে বেশ ভাল হয়, না? সুতরাং স্থির হইল যে, রামের সহিত সীতার, লক্ষ্মণের সহিত ঊর্মিলার, ভরতের সহিত মাণ্ডবীর, আর শত্রুঘ্নের সহিত শ্রুতকীর্তির বিবাহ হইবে।

 সুন্দর সময়ে অগ্নিসাক্ষী করিয়া মহা ধুমধামে শুভকার্য শেষ হইল; সেদিন মিথিলায় কী আনন্দই হইয়াছিল! যেদিকে তাকাও কেবলই আলো, আর নিশান, আর ধূপ-ধুনা, আর মুনিঠাকুর, আর শঙ্খ-ঘণ্টা, আর ঢাক-ঢোল;আর হাতি ঘোড়া, আর মিঠাই সন্দেশ, আর ভিখারী বৈষ্ণব, আর হাসি তামাশা, ছুটাছুটি, ভোজন, ভোজন, কোলাহল, কোলাহল, কোলাহল।

 পরদিন সকালে বিশ্বামিত্র হিমালয়ে চলিয়া গেলেন। দশরথও অযোধ্যায় যাইবার আয়োজন করিতে লাগিলেন। জনক প্রত্যেক মেয়েকে কী দিয়াছিলেন শুনিবে? প্রত্যেক মেয়েকে তিনি এক-এক লক্ষ গরু দিয়াছিলেন। আর হাতি, ঘোড়া, সিপাহি, সোনা, রূপা, মণি, মুক্তা, রেশমী কাপড়, কম্বল ইত্যাদি কত যে দিয়াছিলেন, আমি তাহার হিসাব দিতে পারিব না। ইহার উপর আবার এক-এক শত করিয়া সখী, এক-এক শত দাসী, আর এক-এক শত চাকর। এইরূপে আদর যত্ন করিয়া জনক সকলকে বিদায় করিলেন। দশরথও মনের সুখে অযোধ্যায় চলিলেন।

 এমন সময় দেখ কী সর্বনাশ উপস্থিত! পাখিরা চ্যাঁচাইতেছে, জন্তুরা ছুটিয়া পালাইতেছে, পৃথিবী কাঁপিতেছে, ঝড় বহিতেছে, গাছ ভাঙিয়া পড়িতেছে, সূর্য ঢাকিয়া গিয়াছে, চারিদিক অন্ধকার। সকলে ভয়ে অস্থির, না জানি এর পর কী বিপদ হইবে।

 বিপদ যে কি, তাহা জানিতেও বিলম্ব হইল না; কারণ তখনই পরশুরাম আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যে মানুষ পথ দিয়া চলিবার সময় এমন কাণ্ড হয়, তিনি যে কেমন ভয়ঙ্কর লোক