পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

তাহা বুঝিতেই পার। তাঁহার শরীরটা যেন একটা পাহাড়, চোখদুটো যেন আগুনের গোলা! হাতে একখানি ধনুক আছে, তাহা সেই জনক রাজার ধনুকের চেয়ে নিতান্ত কম নহে। আর একখানা কুড়াল যে আছে, তাহার কথা কি বলিব! কুড়াল কাঁধে ফিরেন বলিয়া তাঁহার 'পরশু' অর্থাৎ ‘কুড়ুলে’ রাম নাম হইয়াছে (পরশু অর্থে কুড়াল)। এই কুড়াল দিয়া তিনি, একবার নয়, দুবার নয়, ক্রমাগত একুশবার ক্ষত্রিয়দিগকে কাটিয়া খণ্ড-খণ্ড করিয়াছেন। তাহাদের অপরাধ এই যে, কার্তবীর্যার্জুন নামক তাহাদের একজন তাঁহার বাপ জমদগ্নি মুনিকে মারিয়া ফেলে।

 এতদিনে তাঁহার রাগটা একটু কমিয়া গিয়াছে। এখন আর ক্ষত্রিয় দেখিলেই তাহাকে ধরিয়া মারেন না। কিন্তু রামের উপর তিনি বড়ই চটিয়া গিয়াছেন। তিনি আসিয়া রামকে সম্মুখে দেখিতে পাইয়াই বলিলেন 'তুমি নাকি বড় বীর হইয়াছ? শিবের ধনুক ভাঙিয়াছ? বটে! আচ্ছা, আমি এই আর-একখানি ধনুক আনিয়াছি। এখানিতে একবার তীর চড়াইয়া টান দেখি! যদি পার, তবে তোমার সহিত যুদ্ধ করিব।'

 ইহা শুনিয়া দশরথের বড় ভয় হইল। তিনি মনে করিলেন, না জানি এই সর্বনেশে মানুষ রামের কী ভয়ানক অনিষ্টই করিবেন! তাই তিনি রামকে ছাড়িয়া দিবার জন্য পরশুরামকে অনেক মিনতি করিলেন। কিন্তু পরশুরাম কি তাহা শোনেন। তিনি রামকে বলিলেন, ‘বিশ্বকর্মা দু-খানি বড় ধনুক প্রস্তুত করিয়াছিলেন; তাহার একখানি তুমি ভাঙিয়াছ, আর একখানি এই আমার হাতে আছে। এখানি সেখানার চেয়ে কম নয়। এখন বলিতেছি, আমার এই ধনুকখানিতে তীর চড়াও, দেখি তুমি কেমন ক্ষত্রিয়!'

 ক্ষত্রিয়কে 'দেখি তুমি কেমন ক্ষত্রিয়’ বলিলে বড়ই অপমানের কথা হয়। সে তাহা কিছুতেই সহিয়া থাকিতে পারে না। কাজেই তখন রাম বলিলেন, 'আচ্ছা তবে দেখুন।’ এই বলিয়া তিনি ধনুকখানি লইয়া তাহাতে গুণ দিলেন। তারপর একটি বাণ তাহাতে চড়াইয়া বলিলেন, মুনিঠাকুর, আপনি ব্রাহ্মণ, আমার গুরুলোক; তাই এই বাণ আমি আপনার উপর ছুঁড়িতে ইচ্ছা করি না; কেন না, তাহা হইলে আপনি মরিয়া যাইবেন। তবে আপনি তপস্যা করিয়া যে সকল জায়গা পাইয়াছে, আমি ইচ্ছা করিলে তাহা নষ্ট করিয়া দিতে পারি, না হয় আপনার আকাশে চলাফেরার পথ বন্ধ করিয়া দিতে পারি। এখন বলুন ইহার কোন্‌টা করিব?

 এতক্ষণে পরশুরামের সে রাগ নাই। তিনি খুবই জব্দ হইয়া গিয়াছেন। তাই তিনি নরম হইয়া বলিলেন, 'রাম, আমার তপস্যায় পাওয়া স্থানগুলিই না হয় নষ্ট করিয়া দাও, কিন্তু আমার পথ আটকাইও না। তোমার ভাল হউক। আমি বুঝিতে পারিয়াছি তুমি যে-সে লোক নহ।' সুতরাং রাম তীর ছুঁড়িয়া পরশুরামের তপস্যায় পাওয়া জায়গাগুলি নষ্ট করিয়া দিলেন; তাঁহার পথ আটকাইলেন না। তখন পরশুরাম সেখান হইতে চলিয়া গেলেন, আর আর সকলে অযোধ্যায় চলিয়া আসিল।

 তারপর রাণীরা কত আদর করিয়া বউ ঘরে লইলেন সে আর বেশী করিয়া কি বলিব? সে সময় পূজা অর্চনা, গান বাজনা, আমোদ আহ্লাদ অবশ্যই হইয়াছিল। রাণীরা বউদিগকে আশীর্বাদ করিয়া বসন ভূষণ কত কী দিয়াছিলেন, সে খবর কে রাখে!

 আমি কেবল ইহাই জানি যে, ইহার কিছুদিন পরে ভরত আর শত্রুঘ্ন মামার বাড়ি বেড়াইতে গেলেন।