স্থির হইল যে, পরদিনই রামকে যুবরাজ করা হইবে। সে সংবাদে অযোধ্যায় হুলুস্থুল পড়িয়া গেল। অযোধ্যার লোকেরা মনের আনন্দে আর ঘরের ভিতরে না থাকিতে পারিয়া পথে আসিয়া কোলাহল করিতে লাগিল। গাড়ি ঘোড়া লইয়া আর চলিবার জো রহিল না। সকলের মুখে খালি রামের কথা! কেহ বলিতেছে, বাঃ, মহারাজ কী ভাল কাজই করিলেন!, কেহ বলিতেছে, ‘মহারাজ চিরজীবী হউন! ‘
রাণী কৈকেয়ীর একটা দাসী ছিল। তাহার নাম ছিল মন্থরা;কিন্তু তাহার পিঠে একটা মস্ত কুঁজ ছিল বলিয়া সকলে তাহাকে কুঁজী বলিয়া ডাকিত। যেমন কদাকার চেহারা, তেমনি তাহার কুটিল মন ছিল। উহার ঐ মস্ত কুঁজটার ভিতরে বুঝি খালি হিংসা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কৈকেয়ী ঐ দাসীটিকে বাপের বাড়ি হইতে আনিয়াছিলেন, কাজেই তাহাকে বড় আদর করিতেন।
সকালবেলা লোকের কলরব শুনিয়া কুঁজী ছাতে উঠিয়া দেখিতে গেল কিসের গোলমাল। সেখানে গিয়া দেখিল যে, রাস্তায় চন্দনের জল আর পদ্মের পাপড়ি ছড়ানো হইয়াছে, নিশান উড়িতেছে আর চারিদিকে কেবল গান বাজনা আর কোলাহল শুনা যায়। ইহাতে কুঁজীর মনে বড়ই ভাবনা উপস্থিত হইল। উহার কাছেই একটি ঝি রেশমী কাপড় পরিয়া হাসিমুখে দাঁড়াইয়া ছিল। কুঁজী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘হ্যা ঁগা, রামের মা কৌশল্যা কিসের জন্য লোককে এত টাকা দিতেছে? ও যে কৃপণ, তবুও এমন করিয়া টাকা দিতেছে, ব্যাপারখানা কী?’ ঝি বলিল, ‘কাল যে রাম যুবরাজ হইবেন। ‘
এই কথা শুনিয়া আর কি কুঁজী হিংসায় স্থির থাকিতে পারে? সে হিংসায় যে তার কুঁজ তখন ফাটিয়া যায় নাই, ইহাই আশ্চর্য! ফাটিলে ভালই ছিল। কৈকেয়ী তখন শুইয়া ছিলেন। কুঁজী সেখানে ছুটিয়া আসিয়া তাঁহাকে তাড়া—কি তাড়া! বড় যে শুইয়া আছ? দেখিতেছ যে তোমার সর্বনাশ হইয়া গেল? শীঘ্র উঠ! ‘
কুঁজীর রাগ দেখিয়া কৈকেয়ী আশ্চর্য হইয়া বলিলেন,’ কী হইয়াছে মন্থরা? আমার কোন বিপদ হইয়াছে কি? তুমি এত ব্যস্ত হইয়াছ কেন?’ মন্থরা দাঁত মুখ খিচাইয়া বলিল, ‘তোমার যাতে সর্বনাশ হয় তাহাই হইয়াছে! কাল মহারাজ রামকে যুবরাজ করিবেন! ‘
এ কথা শুনিয়া কৈকেয়ীর এত আনন্দ হইল যে তিনি তখনই একখানা দামী গহনা কুঁজীকে পুরস্কার দিয়া ফেলিলেন। কুঁজী তাহা দূরে ফেলিয়া দিয়া কহিল, কী বোকা! এমন বিপদে পড়িয়াও আবার আমোদ করিতেছ! রাম রাজা হইলে ভরতের সর্বনাশ হইবে না বুঝি? আর তুমিও বুঝে তখন কৌশল্যা রাণীর দাসী হইয়া থাকিবে না? ‘
কৈকেয়ী বলিলেন, মন্থরা, রাম বড়ই ধার্মিক আর তিনি যখন বড় ছেলে তখন তাহারই তো রাজ্য পাওয়া উচিত। রাম আমাকে যেমন যত্ন করেন ভরতও তেমন করে না। আমি ভরতকে যেমন ভালবাসি, রামকেও তেমনি ভালবাসি। রাম রাজা হইলে দেখিবে, তিনি ভাইদিগকে কত সুখে রাখিবেন। ‘
কুঁজী লম্বা নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, হায় হায়, এ কেমন মেয়ে গোয় আমি তোমার ভালোর জন্য এত করি, আর তুমি আমার কথায় কানই দাও না! রাম রাজা হইলে নিশ্চয় ভরতকে তাড়াইয়া দিবে, না হয় মারিয়া ফেলিবে:আর সেই রামের যে মা, কৌশল্যা রাণী, তাহাকে তো এতদিন তুমি অগ্রাহ্যই করিয়াছ। সে কি তখন তাহার শোধ সইতে ছড়িবে? তাই বলি,