ততক্ষণে সূর্য উঠিয়াছে সেদিনকার কাজ আরম্ভ করিবার সময় হইয়াছে। রামকে যুবরাজ করিবার সকল আয়োজন প্রস্তুত। পুরোহিত বশিষ্ঠ মুনি মন্ত্রী সুমন্ত্রকে ডাকাইয়া বলিলেন, সুমন্ত্র, সব প্রস্তুত, সকলেই আসিয়াছেন, সময়ও হইয়াছে শীঘ্র মহারাজকে সংবাদ দাও। সুমন্ত্র সংবাদ দিতে গেলেন। এদিকে যে সর্বনাশ হইয়াছে তিনি তাহার কিছুই জানেন না। তিনি অন্যান্য দিনের মত গিয়া রাজাকে বলিলেন, মহারাজ, সব প্রস্তুত এখন মহারাজের অনুমতি হইলেই রামকে যুবরাজ করা যায়।’
সুমন্ত্রের কথা শুনিয়া রাজার দুঃখ দ্বিগুণ হইয়া উঠিল। তখন সুমন্ত্র চমকিয়া গিয়া দেখিলেন যে, রাজার চোখ লাল, আর তাঁহাকে বড়ই কাতর দেখা যাইতেছে। তিনি ইহার কিছুই বুঝিতে না পারিয়া মনের দুঃখে কেবল জোড়হাত করিয়া দাড়াইয়া রহিলেন। রাজার কথা করিবার শক্তি নাই। তাহা দেখিয়া মিথ্যাবাদী কৈকেয়ী নিজেই কহিলেন, “দেখ সুমন্ত্র, রাজার মনে কিনা বড়ই আনন্দ হইয়াছে, তাই রাত্রে তাঁহার ঘুম হয় নাই। এখন তিনি একটু ঘুমাইবেন। তুমি রামকে এইখানে লইয়া আইস। একথায় সুমন্ত্র রামকে আনিতে গেলেন।
রাম তাঁহার নিজের বাড়িতে সীতার কাছে বসিয়া আছেন, এমন সময় সুমন্ত্র সেখানে গিয়া বলিলেন, “যুবরাজ, মহারাজ আর রাণী কৈকেয়ী আপনাকে দেখিতে চাহেন; শীঘ্র সেখানে চলুন। রাম তখনই তাহার সঙ্গে চলিয়া আসিলেন। আসিবার সময় পথের লোকেরা তাহার কতই প্রশংসা করিতে লাগিল, কতই আশীর্বাদ করিল।
রাজা দশরথ ভয়ানক দুঃখে অবশ হইয়া আছেন;কৈকেয়ী কাছে বসিয়া আছেন। এমন সময় রাম আসিয়া তাহদের দু-জনকে প্রণাম করিলেন। দশরথ কেবল একটিবার তাহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “রাম!’ আর কথা বাহির হইল না; খালি চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। তাহা দেখিয়া রামের মনে কী পর্যন্ত দুঃখ আর চিন্তা হইল, সহজেই বুঝিতে পার। তিনি কৈকেয়ীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মা, আমি কি না জানিয়া কোন দোষ করিয়াছি? বাবা কেন কথা কহিতেছেন না? তাহাকে কেন এমন কাতর দেখিতেছি? কোনও মন্দ সংবাদ আসিয়াছে কি? আপনি তো বাবাকে কিছু বলেন নাই?’
কৈকেয়ী বলিলেন, “তোমার বাবার রাগও হয় নাই, কোন বিপদও হয় নাই। রাজার একটা কাজ করিতে ইচ্ছা হইয়াছে, তোমার ভয়ে তাহা বলিতে পারিতেছেন না। রাজা যখন কাজটা করিবেন বলিয়াছেন, তখন তুমি কিন্তু তাহাতে কোনরূপ বাধা দিও না;তাহা হইলে যে পাপ হইবে! রাম বলিলেন, মা, এমন কথা কেন বলিতেছেন? বাবা যে কাজ করিবেন বলিয়াছেন, আমি কখনই তাহাতে বাধা দিব না। বাবার কথা কি অমান্য করিতে পারি?'
তাহা শুনিয়া কৈকেয়ী বলিলেন, কথাটি বাপু আর কিছুই নয়। তোমার বাবা আগে আমাকে দুটি বর দিবেন বলিয়াছিলেন, সেই বর আমি আজ চাহিয়াছি। একটা বর এই যে, তুমি মাথায় জটা লইয়া গাছের ছাল পরিয়া, চৌদ্দ বৎসরের জন্য দণ্ডক বনে যাইবে। আর একটা বর চাহিয়াছি যে এই যে সব আয়োজন হইয়াছে, তাহা দিয়া ভরতই রাজা হইবে। তুমি বাছ রাজ্যের লোভ ছাড়িয়া দাও। মহারাজের কষ্ট হইতেছে বলিয়া মুখে এ সকল কথা বলিতে পারিতেছেন না, তাই আমি বলিলাম। পিতার কথা তোমার রাখা উচিত।’
এ কথা শুনিয়া দশরথ দুঃখের নিশ্বাস ফেলিলেন। কিন্তু রাম একটুও দুঃখিত না হইয়া বলিলেন, “আচ্ছ মা, তাহাই করিব। এমন কী কাজ আছে, বাবা বলিলে যাহা না করিতে পারি?