পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৯৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৭৮
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র
পুরী

 আজকাল রেল হইয়া পুরী যাইবার বেশ সুবিধা হইয়াছে, তাই এখন অনেকেই শখ করিয়া সেখানে গিয়া থাকেন। যাইবার পথটি বেশ। অনেকগুলি সুন্দর-সুন্দর নদী পার হইতে হয়। আর বালেশ্বর ছাড়াইলে পথের দুধারে অনেক পাহাড়ও দেখা যায়। নদীগুলির এক-একটা খুব চওড়া, তাহার উপরে বড়-বড় পোল আছে। পার হইবার সময় দু-একটা কুমিরও যে না দেখা যায়, এমন নহে। পাহাড়গুলিও নিতান্ত ছোট নহে, আর দেখিতেও বেশ। মাঝে মাঝে দূর হইতে এক-একটা মস্ত পাহাড় দেখা যায়, তাহার মাথা মেঘে ঢাকা। আবার পথের পাশ্বেই এক-একটা লাল রঙের পাহাড়ে ছোট-ছোট ঝোপের শোভাও চমৎকার লাগে।

 হাবড়া হইতে বালেশ্বর পর্যন্ত পথের দুধারেই প্রকাণ্ড মাঠ, কাছে লোকের বসতি বড় বেশি দেখা যায় না। কাকর মাটি তাহাতে খুব বেশি, গাছপালাও জন্মায় না। সুতরাং এই পথটুকু ভালো না লাগিবারই কথা। সুখের বিষয় এই যে, রাত্রির মধ্যেই ট্রেন এইসকল স্থান পার হইয়া যায়। বালেশ্বর গিয়া ভোর হয়।

 তবে এই মাঠের ভিতরেও যে দেখিবার একেবারে কিছুই নাই, তাহা নহে। হাঁটিয়া শ্রীক্ষেত্র যাইবার সেই পুরানো পথ এই মাঠের উপর দিয়াই গিয়াছে। রেল হইতে বার বার সেই পথ দেখিতে পাওয়া যায়। দেখিবার যে উহাতে এমন বিশেষ কিছু আছে, তাহা নহে। আমাদের দেশী বিশ্রীগোছের পাকারাস্তা যেমন হইয়া থাকে, এও সেইরূপ। তোমরা দেখিলে উহাকে কিছুমাত্র ভালো বলিবে না। তথাপি আমি উহাকে বার বার দেখিয়াও ক্লান্ত হই নাই। আমার যে বড়ই সুন্দর লাগিয়াছিল, তাহা নহে;কিন্তু ঐ পথটাকে দেখিয়া আমার ছেলেবেলার অনেক কথা মনে হইতেছিল। ঐ পথ দিয়া কত লোক শ্রীক্ষেত্র গিয়াছেন। ছেলেবেলা তাহদের অনেকের মুখে এই পথের বর্ণনা শুনিয়াছি। মাথা-ফাটানো রৌদ্রের মধ্যে তপ্ত কাকরের উপর দিয়া পথ চলা। পা ফুলিয়া যায়, পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, তথাপি উৎসাহের ত্রুটি নাই। পুরুষদের চাইতে স্ত্রীলোকদেরই উৎসাহ বেশি। একটি বৃদ্ধা গ্রামের কয়েকটি ভদ্রলোকের সঙ্গে জগন্নাথ দর্শনে গিয়াছিলেন। তিনি মহাপ্রসাদ, জগন্নাথের ছবি, সমুদ্রের ফেনা, হোগলার ঠোঙ্গা, হোগলার পাখা প্রভৃতি অনেক আশ্চর্য জিনিস লইয়া দেশে ফিরিলে পর, বহুদিন পর্যন্ত আমরা তাহাকে মুহুর্তের জন্য বিশ্রাম করিতে দিই নাই। জগন্নাথের চেহারা কেন ওরূপ হইল? সুভদ্রা ঠাকুরুণ ভাইদের মাঝখানে অমন জড়সড় হইয়া আছেন কেন? কালাপাহাড় কিরকম ভয়ানক লোক ছিল? ইত্যাদি কথা শুনিতে শুনিতে আমাদের মুখের হা আর চোখ ক্রমে গোলাকার হইয়া উঠিত। আর শেষকালে সেই বৃদ্ধ যখন — ঠাকুর ফুলা পায় খোড়াইতে খোড়াইতে কিরূপ করিয়া আক্ষেপ করিয়াছিলেন, তাহার অভিনয় করিয়া দেখাইতেন, তখন ব্যাপার যাহা হইত সে আর কি বলিব!

 সেই — ঠাকুর এই পথে শ্রীক্ষেত্র গিয়াছিলেন। এই পথে খোড়াইতে খোড়াইতে তিনি আক্ষেপ করিয়াছিলেন। তাঁহার নামটি পর্যন্ত এতদিনে ভুলিয়া গিয়াছি, কিন্তু তথাপি কিরূপ করিয়া তিনি এই পথে গিয়াছিলেন তাহা যেন স্পষ্ট মনে হইতেছিল।

 আর মনে হইতেছিল সেই বুড়ো ওড়িয়া পাগুটির কথা, শিশুকালে যাহার সহাস্য মুখখানি