পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
২৫

প্রাণের বিচিত্র লীলাকে মিলিয়ে নিয়ে একটি অখণ্ড লীলা। নিজের জীবনে যা বোধ করচি, যা ভোগ করচি, চারিদিকে ঘরে ঘরে জনে জনে মুহূর্তে মুহূর্তে যা-কিছু উপলব্ধি চলেচে, সমস্ত এক হয়েছে একটি বিরাট অভিজ্ঞতার মধ্যে। অভিনয় চলেচে নানা নাটকে নিয়ে, সুখ দুঃখের নানা খণ্ড-প্রকাশ চলচে তাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র জীবনযাত্রায়, কিন্তু সমস্তটার ভিতর দিয়ে একটা নাট্যরস প্রকাশ পাচ্চে এক পরম দ্রষ্টার মধ্যে যিনি সর্বানুভূঃ। এতকাল নিজের জীবনে সুখ-দুঃখের যে-সব অনুভূতি একান্তভাবে আমাকে বিচলিত করেচে, তাকে দেখতে পেলুম দ্রষ্টারূপে এক নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়িয়ে।

 “এমনি করে আপনা থেকে বিবিক্ত হয়ে সমগ্রের মধ্যে খণ্ডকে স্থাপন করবামাত্র নিজের অস্তিত্বের ভার লাঘব হয়ে গেল। তখন জীবনলীলাকে রসরূপে দেখা গেল কোনো রসিকের সঙ্গে এক হয়ে। আমার সেদিনকার এই বোধটি নিজের কাছে গভীরভাবে আশ্চর্য হয়ে ঠেকল।

 “একটা মুক্তির আনন্দ পেলুম।স্নানের ঘরে যাবার পথে একবার জানলার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম ক্ষণকালের অবসর যাপনের কৌতুকে।সেই ক্ষণকাল এক মুহূর্তে আমার সামনে বৃহৎ হয়ে উঠল। চোখ দিয়ে জল পড়চে তখন ইচ্ছা করছে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন ক’রে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করি কাউকে। কে সেই আমার পরম অন্তরঙ্গ সঙ্গী যিনি আমার সমস্ত ক্ষণিককে গ্রহণ করচেন তাঁর নিত্যে। এষোহস্য পরম আনন্দঃ, আমার মধ্যে এ এবং সে- এই এ যখন সেই সে-র দিকে এসে দাঁড়ায় তখন তার আনন্দ॥”

 এই উপলব্ধির মধ্যে প্রধান বা মূল কথা যেটি, তাহাকেই প্রথম গ্রহণ করা যাইতেছে। সেই প্রধান কথাটি হইল এই—“এতকাল নিজের জীবনে সুখদুঃখের যে-সব অনুভূতি একান্তভাবে আমাকে বিচলিত করেচে, তাকে দেখতে পেলুম দ্রষ্টারূপে এক নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়িয়ে।” এখন প্রশ্ন, কে এই ‘নিত্যসাক্ষী’?

  ইনিই যে অন্তর্যামী ব্রহ্ম, তাহা আমরা একটু পরেই যথাস্থানে দেখিতে পাইব। আপাততঃ এইটুকু বলিয়া রাখা যাইতেছে যে, এই নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়াইয়াছিলেন বলিয়া রবীন্দ্রনাথ নিজেও দ্রষ্টার আসনে উন্নীত হইয়াছিলেন। এই নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়াইয়া দেখিলেই খণ্ডকে উত্তীর্ণ হইয়া ‘অখণ্ডলীলাকে’ দেখা সম্ভবপর হয়; তাঁহার পাশে স্থান গ্রহণ করিলেই ‘সমগ্রের মধ্যে খণ্ড’আপন অর্থ— ও সার্থকতা পায় এবং এই নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়াইতে পারিলেই নিজের অস্তিত্বের