প্রসঙ্গত একটা কথা বলা যাইতেছে যে, এখানে যিনি নাট্যকার, রসিক, পরম অন্তরঙ্গ সাক্ষী, নিত্যসাক্ষী ইত্যাদি রূপে অভিব্যক্ত ও অভিহিত, তাঁহাকেই তাঁহার কবিজীবনে রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন— ‘জীবনদেবতা’। ১৩১৪ সালের মাঘ মাসে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় নিজের আত্মপরিচয় প্রবন্ধে তিনি লিখিয়াছেন—
“এই যে কবি, যিনি আমার সমস্ত ভালোমন্দ, আমার সমস্ত অনুকূল ও প্রতিকূল উপকরণ লইয়া আমার জীবনকে রচনা করিয়া চলিয়াছেন, তাঁহাকেই আমার কাব্যে আমি ‘জীবনদেবতা’ নাম দিয়াছি। তিনি যে কেবল আমার এই ইহজীবনের সমস্ত খণ্ডতাকে ঐক্যদান করিয়া বিশ্বের সহিত আমার সামঞ্জস্য স্থাপন করিতেছেন, আমি তাহা মনে করি না— আমি জানি, অনাদিকাল হইতে বিচিত্র বিস্মৃত অবস্থার মধ্য দিয়া তিনি আমাকে আমার এই বর্তমান প্রকাশের মধ্যে উপনীত করিয়াছেন:—সেই বিশ্বের মধ্য দিয়া প্রবাহিত অস্তিত্বধারার বৃহৎ স্মৃতি তাঁহাকে অবলম্বন করিয়া আমার অগোচরে আমার মধ্যে রহিয়াছে॥”
এই ‘জীবনদেবতা’ এই রসিক এবং এই মহাকবিকে লক্ষ্য করিয়া রবীন্দ্রনাথ সত্তর বৎসর বয়সে আপন আত্মপরিচয়ে ঘোষণা করিয়াছেন—
“আমি সেই বিচিত্রের দূত। বিচিত্রের লীলাকে অন্তরে গ্রহণ করে তাকে বাহিরে লীলায়িত করা—এই আমার কাজ।... আজ আমার আর সংশয় নেই, আমি চঞ্চলের লীলাসহচর।”
পরবর্তীকালে ইহাকেই তিনি নাম দিয়েছেন—বিরাট পুরুষ, মহামানব। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাহা খুলিয়া বলিয়াছেন—“এখন নাম দিয়াছি মহামানব এই পরমাত্মা মানবপরমাত্মা, ইনি সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ, ইনি আছেন সর্বদা জনে জনের হৃদয়ে, সমস্ত মানুষের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান নিয়ে তিনি সর্বজনের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিতঃ।”
এখন গোড়ার কথায় ফিরিয়া আসা যাক্। রবীন্দ্রনাথের জীবনের যে–উপলব্ধিটির আলোচনা এতক্ষণ করা গিয়াছে, আদিতেই বলা হইয়াছে যে, তাহার প্রধান কথাটি হইল—জীবন ও জগৎকে “দেখতে পেলুম দ্রষ্টারূপে এক নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়িয়ে। এমনি ক’রে আপনা থেকে বিবিক্ত হয়ে সমগ্রের মধ্যে খণ্ডকে স্থাপন করবামাত্র নিজের অস্তিত্বের ভার লাঘব হয়ে গেল।”
উপলব্ধির এই প্রধান কথাটিই প্রধান প্রমাণ যে, রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ, তিনি ঋষি। প্রমাণটির একটু শাস্ত্রীয় সমর্থন অতঃপর প্রদত্ত হইতেছে।
শ্বেতাশ্বতর এবং মুণ্ডক উভয় উপনিষদে ব্রহ্ম সম্বন্ধে এই মন্ত্র দুইটি