স্বীকৃত হইল যে, শরীরের মধ্যে আগুন আছে, শরীরের তাপই তাহার প্রমাণ, কারণ তাপ কখনো অগ্নিকে ছাড়া বা ছাড়িয়া থাকিতে পারে না।
ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রে আছে—
“হে বরুণ! তোমারই যে তেজ ও শক্তি সমুদ্র-সলিলে বাড়বাগ্নি, তাহাই অন্তরীক্ষে সূর্যাগ্নি, প্রাণি-জঠরে জঠরাগ্নি, মেঘমণ্ডলে বিদ্যুদগ্নি এবং রণভূমিতে তাহাই বীরের হৃদয়ে শৌর্যাগ্নিরূপে অবস্থিত॥”
যে চৈতন্যময়ী মহাশক্তি জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সর্বত্র এবং সর্ববস্তুতে অবস্থিত ও ক্রিয়াশীল, তাহাকেই এখানে বৈদিক-ঋষি তেজ বা অগ্নিরূপে অভিহিত করিয়াছেন, ভূমিকা হিসাবে এই সত্যটুকুর ইঙ্গিত করিয়া রাখা গেল।
দেহের তাপ হইতে দেহস্থ অগ্নির আমরা অনুমান করিয়াছি। কিন্তু দেহে অস্ত্রোপচার করিয়া কোন ডাক্তারই কণামাত্র অগ্নিরও সাক্ষাৎ পাইবেন না। কিন্তু এ কোন্ আগুন যাহাকে দেখা যায় না, অথচ যাহার তাপ পাওয়া যায়?
এ প্রশ্নের উত্তরও এখন থাক; বরং অন্য একটি প্রশ্ন গ্রহণ করা যাক— শরীরের এই অগ্নি কোথায় থাকে, যাহা দেহে তাপরূপে এবং জঠরে ভুক্তদ্রব্যের পরিপাচক জঠরাগ্নিরূপে ক্রিয়াশীল? এই প্রশ্নের উত্তর ডাক্তারী-শাস্ত্রে নাই, অন্যত্র ইহার অন্বেষণ করিতে হইবে।
ব্রহ্মসূত্রের একটি সূত্র এই—
“অস্যেব চোপপত্তেরূষ্মা”, অস্যার্থঃ সূক্ষ্মশরীরেরই ধর্মভূত ঊষ্মা (উত্তাপ) স্থূলদেহে দৃষ্ট হয়; কারণ সূক্ষ্মশরীর নিষ্ক্রান্ত হইলে স্থূলদেহে ঊষ্মা দৃষ্ট হয় না॥
ভগবান বেদব্যাসের ব্রহ্মসূত্রটি হইতে অন্তত এইটুকু প্রতিপন্ন হয় যে, স্থূলদেহের উত্তাপ তাহার নিজের নহে, তাহা সূক্ষ্মদেহের। কাজেই আমাদের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর ব্রহ্মসূত্র হইতে পাওয়া যাইতেছে যে, শরীরের যে আগুন আমরা অনুসন্ধান করিতেছি, তাহা এই দেহে নাই, তাহা আছে শরীরের মধ্যস্থ সূক্ষ্মদেহে। স্থূলদেহে সে আগুন নাই বলিয়াই শরীর চিরিয়াও কোন ডাক্তার তাহাকে দেখিতে পান না; স্থূলদেহে সে-আগুন থাকিলে আমরা চক্ষুষ্মান ব্যক্তিমাত্রেই তাহাকে দেখিতে পাইতাম।
রবীন্দ্রনাথ কেন যে ‘দেহের যবনিকা’- বাক্যটি ব্যবহার করিয়াছেন, তাহার ইঙ্গিত যেন এখন কতকটা স্পষ্ট হইয়া আসিতেছে বলিয়াই মনে হইবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ‘দেহের যবনিকা ভেদ’ করিয়াই তবে ‘দীপ্তিময়ী শিখাকে’ দেখিতে