পাইয়াছেন, আর সূক্ষ্মদেহ সূক্ষ্ম হইলেও দেহ। কাজেই রবীন্দ্রনাথের দৃষ্ট ‘অনির্বাণ দীপ্তিময়ী শিখা’ সূক্ষ্ম শরীরেও নাই, তাহা অন্যত্র, এইটুকু অন্তত এখন অনুমান করিয়া লওয়া যাইতে পারে।
পাতঞ্জলসূত্রে বিভূতিপাদে একটি সূত্র আছে—“মূর্ধ্বজ্যোতিষি সিদ্ধদর্শন।”
ভগবান বেদব্যাস সূত্রটির ভাষ্য করিয়াছেন—“শিরঃ কপালেহন্তশ্ছিদ্রং প্রভাস্বরং জ্যোতি...... শিরস্থ কপালের মধ্যে যে ছিদ্র আছে, তন্মধ্যে যে ভাস্বর জ্যোতি বিদ্যমান ইত্যাদি॥”
এখানে পাওয়া গেল যে কপালের অন্তশ্ছিদ্রে দীপ্তিমান এক জ্যোতি রহিয়াছে। যোগসূত্রের সেই ‘ভাস্বরজ্যোতি’-কেই কি রবীন্দ্রনাথ ‘অনির্বাণ দীপ্তিময়ী শিখা’ বলিয়াছেন?
অনেক ভাষ্যকার অবশ্য মস্তকের অভ্যন্তরস্থ এই জ্যোতিকেই আত্মজ্যোতি বলিয়াছেন॥ আমরা শুধু এই তথ্যটুকুই মাত্র গ্রহণ করিয়াছি যে, যোগসূত্র এবং ভগবান বেদব্যাসের অভিমতে মস্তকের অভ্যন্তরে এক উজ্জ্বল জ্যোতির্শিখা রহিয়াছে। কাজেই, দেহের যবনিকার আড়ালে রবীন্দ্রনাথ যে ‘দীপ্তিময়ী শিখা’ দেখার কথা বলিয়াছেন, তাহাকে এখন অবিশ্বাস্য ব্যাপার বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া নিশ্চয় চলে না। সে-জ্যোতি ব্রহ্মজ্যোতি কি না, সে অবশ্য পৃথক বিচার্য।
“যোগি-যাজ্ঞবল্ক্য” নামক যোগগ্রন্থে আত্মস্বরূপ জানিবার জন্য যে ধ্যানের উপদেশ রহিয়াছে, তাহাঁতে বলা হইয়াছে “ভারূপমমৃতং ধ্যায়েদ ভ্রুমধ্যে”—ভ্রূযুগলের মধ্যে জ্যোতির্ময় ও অমৃতময় স্বরূপকে ধ্যান করিবে।
এই স্থানকেই যোগের পরিভাষায় ‘আজ্ঞাচক্র’ বলা হয়। পাতঞ্জল-সূত্রের মূর্ধজ্যোতি এবং ‘যোগী-যাজ্ঞবল্ক্য’-এর আজ্ঞাচক্রের জ্যোতি একই কি না, সে প্রশ্ন এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক বা অবান্তর। যোগিগণের ধ্যানলব্ধ বা ধ্যানদৃষ্ট একটি ‘জ্যোতি’ দেহমধ্যে অবস্থিত রহিয়াছে, এই তথ্য বা তত্ত্বই আমাদের এখানে প্রধান জ্ঞাতব্য। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ যে বলিয়াছেন ‘দেহের যবনিকা’ ভেদ করিয়া তিনি ‘অনির্বাণ দীপ্তিময়ীশিখা’ দেখিয়াছেন, সে-কথার সমর্থন প্রামাণ্য যোগগ্রন্থদ্বয়ে পাওয়া যাইতেছে।
“যোগিযাজ্ঞবল্ক্য” অবশ্য রবীন্দ্রনাথের এই ‘দীপ্তিময়ী শিখাকেই' আত্মজ্যাতি বলিয়াছেন দেখা যাইবে—“ললাটমধ্যে যঃ পশ্যতি জ্ঞানময়ীং প্রভাং তু সদা দীপবদূজ্জ্ব্লন্তী, ...... ললাটমধ্যে জ্ঞানময়ী দীপবৎ সমুজ্জ্বলা প্রভা যিনি দর্শন করেন॥”