নীরস অট্টহাসি, এ যেন মরণের অঙ্গুলি নির্দেশ। দেখিয়া রবীন্দ্রনাথের মনে হইল, এই নির্দেশ যেন ইঙ্গিতে এই কথাই কহিতে চাহে—“একদা পশুর যেথা শেষ, সেথায় তোমারও অন্তঃভেদ নাই লেশ।” এই অকথিত উক্তির প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ জানাইয়াছেন—
আমি বলিলাম—
আমি যে রূপের পদ্মে করেছি অরূপ মধুপান,
দুঃখের বক্ষের মাঝে আনন্দের পেয়েছি সন্ধান,
অনন্ত মৌনের বাণী শুনেছি অন্তরে,
দেখেছি জ্যোতির পথ শূন্যময় আঁধার প্রান্তরে।
নহি আমি বিধির বৃহৎ পরিহাস,
অসীম ঐশ্বর্য দিয়ে রচিত মহৎ সর্বনাশ॥
‘রূপের পদ্মে অরূপ মধুপান’ বলিতে রবীন্দ্রনাথ রূপের আড়ালে যিনি অরূপে তাঁহাকেই বুঝাইয়াছেন এবং তিনিই উপনিষদের ব্রহ্ম। উপনিষদ জগতের যাবতীয় রূপকে বলিয়াছেন “অরূপের রূপ”— যাঁহার রূপ নাই, তাঁহারই রূপে এই সমস্ত। অর্থাৎ, জগতের এই বহু রূপ সেই অরূপীরই বহুরূপী প্রকাশমাত্র।
উপনিষদ বলেন, ‘অশব্দমপর্শমরূমব্যয়ম। তথারসং নিত্যমগন্ধবচ্চ”—ব্রহ্ম শব্দহীন রূপহীন, রসহীন, গন্ধহীন, অক্ষরবস্তু॥ ব্রহ্মকে রূপহীন ইত্যাদি বলিয়াই উপনিষদ সেই সঙ্গে ইহাও বলিয়াছেন—
একোহবর্ণো বহুধা শক্তিযোগাৎ
বর্ণান্ অনেকান্ নিহিতার্থো দধাতি॥
—যিনি অদ্বিতীয় ও নির্বিশেষ, তিনিই নিগূঢ় প্রয়োজনে বিবিধ শক্তিযোগে নানা বিভাব ধারণ করেন।
এই কারণেই রূপের পদ্মে অরূপ মধুপান, অর্থাৎ রূপের মাধ্যমেই অরূপকে পাওয়া রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভবপর হইতে পারিয়াছে। অরূপকে পাওয়াই ব্রহ্মপ্রাপ্তি তথা ব্রহ্মদর্শন।
“দুঃখের বক্ষের মাঝে আনন্দের পেয়েছি সন্ধান”—এ কথার অর্থ কি? ইহা দ্বারা রবীন্দ্রনাথ কি বুঝাইতে চাহিয়াছেন?
সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্বমীমাংসা প্রভৃতি সকল দর্শন শাস্ত্রেই জগৎকে ‘দুঃখ’ বলা হইয়াছে। এমন যে গীতা, তিনিও জগতকে ‘দুঃখের আলয়’