চোখ আমার কখনো তাতে ক্লান্ত হলনা, বিস্ময়ের আর অন্ত পাইনি। চরাচরকে বেষ্টন করে অনাদিকালের যে অনাহতবাণী অনন্তকালের অভিমুখে ধ্বনিত তাকে আমার মনপ্রাণ সাড়া দিয়েছে, মনে হয়েছে যুগে যুগে এই বিশ্ববাণী শুনে এলুম॥”
‘অনাদিকালের যে অনাহতবাণী অনন্তকালের অভিমুখে ধ্বনিত’, সেই বাণীরই উপনিষদ নাম দিয়াছেন—শব্দ-ব্রহ্ম।
ইহার পরে এই ‘প্রতিভাষণে’ রবীন্দ্রনাথ খুলিয়াই আত্মপ্রকাশ করিয়াছেন, জনতার মাঝখানে দাঁড়াইয়া নিজের সম্বন্ধে বলিয়া গিয়াছেন—
“প্রতিদিন ঊষাকালে অন্ধকার রাত্রির প্রান্তে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছি এই কথাটি উপলব্ধি করবার জন্য যে, যত্তেরূপং কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি। আমি সেই বিরাট সত্তাকে আমার অনুভবে স্পর্শ করতে চেয়েছি যিনি সকল সত্তার আত্মীয়সম্বন্ধের ঐক্যতত্ত্ব, যাঁর খুশিতেই নিরন্তর অসংখ্য রূপের প্রকাশে বিচিত্রভাবে আমার প্রাণ খুশি হয়ে উঠছে—বলে উঠেছে কোহ্যেবানাৎ কঃ প্রাণ্যাৎ যদেষ আকাশ আনন্দ ন স্যাৎ॥”
তপোবনের ঋষিকেই কি এখানে নূতন মূর্তিতে দেখা যাইতেছে না? ঋষির ব্রহ্ম ঘোষণাই কি তিনি অসংখ্য জনতার মাঝখানে দাঁড়াইয়া এখানে করিয়া যান নাই যে, তিনি তাঁহারই কল্যাণতম রূপকে দেখিয়াছেন, যিনি আকাশ পরিপূর্ণ করিয়া আনন্দ?
সত্তর বৎসরের এই ‘প্রতিভাষণের’ উপসংহারে আসিয়া নিজের সমগ্র জীবন, কর্ম ও কাব্যসৃষ্টি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই রায় দিয়াছেন দেখা যায়—
“সমস্ত আবর্জনা বাদ দিয়ে বাকি যা থাকে আশা করি তার মধ্যে এই ঘোষণাটি স্পষ্ট যে, আমি ভালোবেসেছি এই জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে, আমি কামনা করেছি মুক্তিকে, যে মুক্তি পরম পুরুষের কাছে আত্মনিবেদনে, আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সত্য মহামানবের মধ্যে, যিনি সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ। আমি এসেছি এই ধরণীর মহাতীর্থে—এখানে সর্বদেশ সর্বজাতি এবং সর্বকালের ইতিহাসের মহাকেন্দ্রে আছেন নরদেবতা— তাঁরই বেদীমূলে নিভৃতে বসে আমার অহংকার আমার ভেদবুদ্ধি ক্ষালণ করবার দুঃসাধ্য চেষ্টায় আজও প্রবৃত্ত আছি॥”
যে কথা একান্ত গূঢ় ও গোপন, জনসভায় দাঁড়াইয়া আপনার সেই পরিচয়ই ঋষি কবি এখানে উদ্ঘাটন করিয়াছেন। দেশবাসীর ঐকান্তিক শ্রদ্ধার আড়ালে দেশবাসীর জিজ্ঞাসিত একটি অনুচ্চারিত প্রশ্নই হয়তো তিনি শুনিতে পাইয়াছিলেন