একুশ
কৃষ্ণচন্দ্র দে
আধুনিক বাংলার লোকপ্রিয় সঙ্গীত-ধুরন্ধরদের মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্র দে ঊর্ধ্বাসনের অধিকারী। সে আসনের উচ্চতা কতটা, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই; কিন্তু কোন কোন বিভাগে কৃষ্ণচন্দ্রের আর্ট অতুলনীয় ও অননুকরণীয় হয়ে আছে, একথা বললে অত্যুক্তি করা হবে না।
বয়সে কৃষ্ণচন্দ্র এখন ষাটের পরের ধাপে এসে পড়েছেন (তাঁর জন্ম ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে)। স্বর্গীয় বন্ধুবর নরেন্দ্রনাথ বসুর বাড়ীতে প্রথম যেদিন তাঁর গান শুনি, তখন তিনি বয়সে য়ুবক। সেদিন শিক্ষার্থী হ’লেও তিনি ছিলেন নামজাদা উদীয়মান গায়ক। তারও বহু বৎসর পরে যখন ওস্তাদ ব’লে সর্বত্র সমাদৃত হয়েছেন, তখনও সঙ্গীতকলার প্রত্যেক বিভাগে নতুন কিছু শেখবার জন্যে তাঁকে শিক্ষার্থীর মত আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখেছি। লাটিনে চলতি উক্তি আছে—আর্ট অনন্ত, কিন্তু জীবন হচ্ছে সংক্ষিপ্ত। সংস্কৃতেও অনুরূপ বাণী আছে—“অনন্ত শাস্ত্রং বহু বেদিতব্যং স্বল্পাশ্চ আয়ঃবহবশ্চ বিঘ্না।” এমন শ্রেষ্ঠ শিল্পী আমি কয়েকজন দেখেছি, যাঁরা ভুলে যেতে চান এই পরম সত্যটি। কৃষ্ণচন্দ্র এ শ্রেণীর শিল্পী নন। নিয়তি তাঁকে দয়া করেনি। ভগবান তাঁকে চক্ষুষ্মান ক’রেই পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাল্য বয়স পর্যন্ত দুই চোখ দিয়ে তিনি উপভোগ করবার সুযোগ পেয়েছিলেন সুন্দরী এই বসুন্ধরার দৃশ্যসঙ্গীত - আলোছায়ার ছন্দ, ইন্দ্রধনুবর্ণের আনন্দ, কান্তারশৈলের সৌন্দর্য ও চলমান তরঙ্গিনীর নৃত্য। কিন্তু কৈশোরেই বঞ্চিত হন দৃষ্টির ঐশ্বর্ষ থেকে। জন্মান্ধ চোখের মর্যাদা ততটা বোঝে না। কিন্তু চক্ষুরত্ন লাভ ক’রেও তা থেকে বঞ্চিত হওয়া, এর চেয়ে চরম দুর্ভাগ্য কল্পনা করা যায় না।
১৬৭