মনোরম। তা শব্দগত নয়, ভাবগত। তার মধ্যে শব্দ-সম্পদের গন্ধ নেই, চেষ্টার লক্ষণ নেই, কিন্তু স্বয়মাগত শব্দ ব্যবহার ক’রে যথাযথ ভাব ফুটিয়ে তোলা হয়। লেখকের মনের কথা স্বাভাবিক ভাবেই পরিণত হয় পাঠকের মনের কথায়। নিজস্ব স্টাইল দেখাবার অছিলায় জোরে জোরে শব্দ-ঝুমঝুমি বাজিয়ে ও বহুতর মুদ্রাদোষের সাহায্য নিয়ে অনেকেই দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে চান, কিন্তু প্রেমেন্দ্রের স্টাইল হচ্ছে স্বভাবসঙ্গত ও অকৃত্রিম। তাকে চালাতে হয় না, সে আপনি চলে। তাঁর ভাষা দেখলে বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশ মনে পড়ে— সরলতাই ভাষার শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার।
ফরাসী সাহিত্যাচার্য ফ্লবেয়ার বলেছিলেন: “সাদা কথায় সাদাকে ফোটানোই হচ্ছে উচ্চতর শক্তির কাজ।” সমালোচকরা ইংরেজী বাইবেলের ভাষার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু তা কত সহজ, কত সরল! আধুনিক যুগের আর এক ফরাসী সাহিত্যাচার্য আনাতোল ফ্রাঁশও ছিলেন একান্তভাবেই জটিলতার বিরোধী। কোনদিন তিনি কুয়াসার ধার দিয়েও যাননি, সাদা কথায় গেয়ে গিয়েছেন আলোকের গান। আবার তাঁরই পাশে দাঁড়িয়ে ফরাসী কবি স্টিফেন ম্যালার্মিকে বলতে শুনি, “এ কবিতাটিকে আবার নতুন ক’রে লিখতে হবে। সবাই কবিতাটিকে পাঠ ক’রে সহজেই বুঝতে পারছে।” ম্যালার্মি’র পরে এলেন পল ভ্যালারি, লোকে তাঁকে বলে, “নীরবতার বাণী” এবং তিনি বলেন— আমার নীরবতা সম্পূর্ণ নির্বাক হ’লেই আমি হতুম মহত্তর। তিনি অভিযোগ করলেন— আনাতোল ফ্রাঁশের রচনা বড় সরল! বঙ্কিমচন্দ্র ও ফ্রাঁশের সেকেলে মত একালে বোধ করি চলবে না। আধুনিকরা হয়তো বলবেন—ভাষার শ্রেষ্ঠ ত্রুটি হচ্ছে, সরলতা। সে যাইই হোক, প্রেমেন্দ্র একেলে লেখক হয়েও যে বঙ্গদেশীয় ম্যালার্মি ও ভ্যালারিদের দলভুক্ত হননি, এইটেই হচ্ছে আনন্দের কথা। বুঝতে পারব না ব’লে লেখা পড়ব? এ মত যুক্তিহীন। এবং এই আজব মতের দোহাই দিলে সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত যাঁরা অতুলনীয় ব’লে স্বীকৃত হয়েছেন, আসর ছেড়ে স’রে পড়তে হবে তাঁদের প্রত্যেককেই। আপন আপন আত্মীয়সভার কবি হচ্ছেন ম্যালার্মি ও ভ্যালারি।
২৬১