একদিন তিনি আমার বাড়ীতে পাঠগৃহের ভিতরে এসে বসলেন। সে ঘরের তিনদিকে ছিল কেতাবের আলমারি। প্রেমেন্দ্র চুপ ক’রে তাকিয়ে তাকিয়ে বইগুলো দেখতে লাগলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, “হেমেনদা, আপনার সম্বন্ধে আমার ধারণা বদলে গেল।”
আমি বললুম, “বদলে গেল? কেন?”
কেতাবের আলমারির দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ ক’রে তিনি বললেন, “এই সব দেখে।”
আগে আমার সম্বন্ধে তাঁর কি ধারণা ছিল, সে কথা আমি আর জিজ্ঞাসা করলুম না, তিনিও খুলে কিছু বললেন না।
তাঁকে ভালোবেসেছিলুম সত্য সত্যই। রাজপথে, প্রকাশকের পুস্তকালয়ে, ফুটবল খেলার মাঠে, যেখানেই তাঁকে দেখেছি, আমার বাড়ীতে ধ’রে এনেছি। একবার কয়েক দিন তাঁর দেখা নেই, অথচ তাঁকে কাছে পাবার জন্যে মন ব্যস্ত হ’য়ে উঠল। কোথায় বাগবাজারের গঙ্গার ধার, আর কোথায় কালীঘাটের আদিগঙ্গার ধার। ট্যাক্সি ডেকে সেই দীর্ঘ পথ অতিক্রম ক’রে একেবারে তাঁর বাড়ীতে গিয়ে হাজির হলুম। তিনি বেরিয়ে আসতেই তাঁকে গ্রেপ্তার ক’রে টেনে আনলুম নিজের বাড়ীতে। তখন তিনি নিজেও প্রায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করতেন। একদিন এলেন যুগলে—অর্থাৎ নব-বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে। নিজেও যেমন ছোট্ট মানুষ, সহধর্মিণীরূপেও বেছে নিয়েছেন তেমনি একটি ছোট্ট তরুণীকে। বলা যায় মানিকজোড়।
ভেবেছিলুম প্রেমেন্দ্রকে পেলুম স্থায়ী বন্ধুরূপে, কিন্তু হঠাৎ সিনেমা এসে বাদ সাধলে। আজ কয়েক বৎসর যাবৎ তিনি অদৃশ্য হয়ে আছেন। সিনেমার যে প্রতিবেশ আমার কাছে অসহনীয়, তার মধ্যেই দিব্য বাহাল তবিয়তে তিনি করছেন জীবনযাপন। তিনি কেবল আমাকেই ভোলেননি, প্রায় ভুলে গিয়েছেন সাহিত্যকেও। আগে তাঁর লেখনী প্রসব করত রচনার পর রচনা। এখন ন-মাসে ছ-মাসে তাঁর কলম থেকে ঝ’রে পড়ে দু-এক ফোঁটা কালি—তাও রীতিমত জোর তাগিদের পর। শ্রীশৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়েরও ঐ দশা।
২৬৩