থেকে নিজের চিত্তকে বিযুক্ত ক’রে অতুলনীয় কাব্যসাধনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন, সেই সময়েই একদিন কবি মোহিতলালের সঙ্গে গিয়ে করুণানিধানের সঙ্গে পরিচিত হলুম। সে হচ্ছে ১৩১৬ কি ১৩১৭ সালের কথা। হেদুয়া পুষ্করিণীর দক্ষিণ দিকে ছিল স্বর্গীয় পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এডওয়ার্ড ইনষ্টিটিউশনের বাড়ী—স্কুলের অস্তিত্ব তখন ছিল কি ছিল না বলতে পারি না। দোতালার বারান্দায় হুঁকো নিয়ে উবু হয়ে ব’সে করুণানিধান ধূমপান করছিলেন। বয়সে তখন তিনি যৌবনসীমা পার হননি, কিন্তু বয়সোচিত কোন সৌখীনতার লক্ষণই তাঁর মধ্যে খুঁজে পেলুম না। শ্যামবর্ণ দীর্ঘ একহারা দেহ, পরনে ইস্ত্রিহীন ছিটের কোট ও আধময়লা কাপড়। মাথায় অযত্ন বিন্যস্ত চুল, মুখে দাড়ীগোঁফের ভিতর দিয়ে থেকে থেকে ফুটে ওঠে সরল, মিষ্ট, মৃদু হাসি। দৃষ্টি ও চেহারা অত্যন্ত নিরভিমান। কবি নয়, নিরীহ ও সাধারণ স্কুলমাষ্টারের চেহারা এবং কলকাতার সহরতলীতে তখন তিনি সত্য সত্যই কোন বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদে বাহাল ছিলেন।
এমন মানুষের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তুলতে বিলম্ব হয় না। তারপর তাঁর সঙ্গে দেখা হ’তে লাগল ঘন ঘন। কখনো অমূল্যবাবুর বাড়ীতে, কখনো তাঁর নিজের বাড়ীতে। দু-একবার তিনি আমার বাড়ীতেও এসে হাজির হয়েছেন। সর্বদাই আত্মভোলা ভাবুকের ভাব, অথচ দৃষ্টি দেখলে মনে হয় যেন তা অন্তর্মুখী, যেন তিনি মনে মনে খুঁজে বেড়াচ্ছেন কোন হারিয়ে যাওয়া রূপের স্বপ্ন। তাঁর কবিতাগুলিই প্রমাণিত করবে, তিনি ছিলেন নিছক সৌন্দর্যের পূজারী, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দারিদ্র্য ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ করতে পারতেন না। কেবল তাঁর জামাকাপড়ই অত্যন্ত স্থূল ও আটপৌরে ছিল না, তাঁর বসতবাড়ীতেও ছিল না সাজসজ্জা বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোন বালাই। কিন্তু চিত্ত যার রূপগ্রাহী, ধূলিশয্যায় শয়ন ক’রেও সে দৃষ্টি নিবদ্ধ ক’রে রাখতে পারে উদার আকাশের নির্মল নীলিমার দিকে।
করুণানিধানের সঙ্গে মন খুলে মেলামেশা করেছি যে কতদিন, তার আর সংখ্যা হয় না। তিনি কেবল নির্বিরোধী ও কোনরকম
৩৫