পাতা:এখন যাঁদের দেখছি - হেমেন্দ্রকুমার রায়.pdf/৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
এখন যাঁদের দেখছি

দ্বারা স্বভাবকে আচ্ছন্ন ক’রে ফেলেন, স্বভাব হয় না স্বতঃস্ফূর্ত। এখানে স্বভাব বলতে আমি বোঝাতে চাই নিসর্গকেই। করুণানিধানের কাব্যে যে নিসর্গ-শোভা ফুটে ওঠে, তার মধ্যে পাওয়া যায় কবির স্বাভাবিক রক্তের টান ও নাড়ীর স্পন্দন। তাঁকেই বলি সত্যিকার স্বভাবকবি। এবং ছোটখাটো খুঁটিনাটির ভিতর দিয়ে বৃহত্তর প্রকৃতির শব্দস্পর্শ গন্ধ ও রূপরসছন্দ প্রকাশ করবার জন্যে তিনি ভাবুকের মত বেছে বেছে যে সব শব্দ উদ্ভাবন করেন, তার মধ্যেও থাকে খাঁটি কলাবিদের হাতের ছাপ। বাংলার কাব্যজগতে তাঁর মত নিসর্গ-চিত্রকর সুলভ নয়।

 কবিবর দেবেন্দ্রনাথ আত্মবিস্মৃতিকে উচ্চাঙ্গ কাব্যের অপরিহার্য লক্ষণ বলেছেন। কিন্তু কেবল কাব্যে নয়, করুণানিধানের ব্যক্তিগত জীবনেও যে আত্মবিস্মৃতির পরিচয় পাওয়া যায়, সাধারণের কাছে তা কৌতুকপ্রদ ব’লে মনে হ’তে পারে। কবির (এবং আমারও) বন্ধু পূর্বোক্ত চারুবাবু আর একদিন আমাকে বলেছিলেন, “করুণার কাণ্ডের কথা শুনেছেন? সেদিন দেখি সে আনমনার মত হেদোর চারিদিকে লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর মাঝে মাঝে হেঁট হয়ে রাস্তা থেকে কি সব কুড়িয়ে নিচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখলুম তার কোটের পকেট রীতিমত ফুলে উঠেছে। পকেট হাতড়ে পাওয়া গেল একরাশ ঢিল, পাটকেল, নুড়ি।” এমন অবোধ শিশুর মত সরলতা বোধ হয় আর কোন বাঙালী কবির মধ্যে আবিষ্কার করা যাবে না।

 করুণানিধানের সঙ্গে দেখা হয়নি সুদীর্ঘকাল। কার্য থেকে অবসর নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন স্বগ্রাম শান্তিপুরে, তাঁর প্রিয় মুখ দেখবার সৌভাগ্য থেকে আমাদের বঞ্চিত ক’রে এবং ততোধিক দুঃখের বিষয় এই যে, জরাজর্জর হবার আগেই ক্রমে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েছে তাঁর কাব্যরচনার প্রেরণা। পনেরো কি বিশ বৎসরের মধ্যে কদাচিৎ তাঁর দু-একটি রচনা চোখে পড়েছে, কিন্তু সেগুলির মধ্যে “ঝরাফুল” প্রণেতার শীলমোহর খুঁজে পাই নি। কবি আছেন, কিন্তু কবিতা নেই। দুর্ভাগ্য।

৩৮