আমাদের সেই সাহিত্যসাধনার উদ্যোগ-পর্বে সত্যানন্দের বাড়িতেই প্রথম দেখি মোহিতলাল মজুমদারকে। সত্যানন্দের সঙ্গে তাঁরও কি যেন একটা দূর-সম্পর্ক ছিল। সে বয়সে আলাপ জমতে দেরি হয় না। বালকরা কথায় কথায় বন্ধু পায় এবং বন্ধু হারায় (আর বলতে কি সাহিত্যক্ষেত্রে তরলমতি বুড়ো খোকারও অভাব নেই)। মোহিতলাল সেখানে গিয়েছিলেন দুই-তিনবার। সে সময়ে কিরকম বিষয়বস্তু আমরা আলাপ্য ব’লে মনে করতুম, আজ আর তা স্মরণে আসছে না। মোহিতলাল সেই বয়সেই কাব্যকুঞ্জবনে প্রবেশ করেছিলেন কিনা, তাও আমি বলতে পারব না। অন্তত তাঁর মুখে থেকে এ সম্পর্কে কোন কথা শুনেছিলাম ব’লে মনে হচ্ছে না। তবে তাঁর দিকে যে আমি আকৃষ্ট হয়েছিলুম, তাতে আর সন্দেহ নেই।
আমাদের সেই সাহিত্যের বেলেখেলাঘরেই মাঝে মাঝে আর একটি বালক আসতেন, পরে যিনি এখানকার সাহিত্য সমাজে বিশেষ আলোড়ন উপস্থিত করেছিলেন। তিনি হচ্ছেন “কল্লোল” সম্পাদক স্বর্গীয় দীনেশরঞ্জন দাস। কিন্তু তিনি তখন কালিকলম নিয়ে সুবোধ বালকের মত ইস্কুলের লেখাপড়া ছাড়া আর কিছু করতেন ব’লে মনে হয় না।
বালক হ’ল যুবক, কাঁচা হ’ল পাকা। কেটে গেল কয়েকটা বছর। আমার নানাশ্রেণীর রচনা প্রকাশিত হয় “ভারতী”, “নব্যভারত”, “মানসী”, “বাণী”, “ঐতিহাসিক চিত্র”, “অর্চনা”, “জন্মভূমি” ও অন্যান্য পত্রিকায়। সেই সময়ে একদিন অধুনালুপ্ত প্রখ্যাত বিদ্যায়তন “শ্রীকৃষ্ণ পাঠশালা”র ত্রিতলের ঘরে গিয়ে সবিস্ময়ে দেখলুম কবির এক পরম সাধক মূর্তি। দেখলুম শয্যাগত, উত্থানশক্তিহীন বৃদ্ধ কবিবর দেবেন্দ্রনাথ সেনকে। তাঁর দৃষ্টি প্রায় অন্ধ, সর্বাঙ্গ বাতে পঙ্গু, হাতে কলম পর্যন্ত ধরতে পারেন না, তবু নিদারুণ রোগযন্ত্রণার মধ্যেও প্রশান্ত আননে মুখে মুখেই তিনি রচনা ক’রে যাচ্ছেন কবিতার পর কবিতা। কোন কবিতার মধ্যেই নেই ব্যাধিজর্জর দেহের দুঃখ-বেদনার সুর, কোন কবিতাতেই নেই অন্ধকারের ছোপ, প্রত্যেক কবিতাই হচ্ছে আলোর কবিতা, যার প্রভাবে হাহাকারও হয় নন্দিত ও নিস্তব্ধ। মন করলে নতিস্বীকার।
৭৩